ক্রাইমবার্তারিপোর্টঃ দিনাজপুরের সেই মুক্তিযোদ্ধাকে শেষ ইচ্ছানুযায়ী রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। মৃত্যুর দুদিন আগে নিজের ক্ষোভ-দুঃখের কথাগুলো লিখে রেখে গিয়েছিলেন স্বজনদের কাছে। বলে গিয়েছিলেন তার মৃত্যু হলে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিদায় নিলেন প্রশাসনের স্যালুট ও বিউগলের করুণ সুর ছাড়াই।
ওই মুক্তিযোদ্ধার নাম ইসমাইল হোসেন। বাড়ি দিনাজপুর সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামে। তার ক্ষোভ, অভিমান ছিল তার এক ছেলের চাকরিচ্যুতি নিয়ে। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গেছেন, ‘অস্ত্র হাতে জীবন বাজি রেখে যে দেশ স্বাধীন করলাম, সে দেশে আমার ছেলের রুজি-রোজগারটুকুও অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয়া হলো! এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি আমার ছেলেকে চাকরি ও বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে। তাই মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অংশ হিসেবে তাদের স্যালুট আমার শেষ যাত্রায় চাই না।’
বুধবার বেলা ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে চিঠিতে উল্লেখ করা ‘শেষ ইচ্ছা’ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ইসমাইল হোসেনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছাড়াই দাফন করা হয়য়। এসময় ‘গার্ড অব অনার’ দিতে আসা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সদস্যদের ফিরিয়ে দেন ইসমাইল হোসেনের স্বজন-পরিজনেরা। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের শেষ বিদায়ে বিউগলে বাজেনি বিদায়ের সুর। এমনকি তার মরদেহ জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিতও করা হয়নি।
পরিবার ও স্বজনেরা জানান, মঙ্গলবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি চিঠি লিখেন মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। পরে এর নিচে সইও করেন। ওইদিনই তা ডাকযোগে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের ঢাকার ঠিকানায় পাঠানো হয়। এর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বুধবার বেলা ১১টায় মারা যান জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
গার্ড অব অনার দিতে যাওয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে ইসমাইল হোসেনের ছেলেরা বলেন, ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বেতন পান। একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি এমন অবহেলা, এর চেয়ে লজ্জার কী হতে পারে। এই কারণেই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করেছেন।’
জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে নূর হোসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ড্রাইভার পদে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাকরি করতেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে ২০১৭ সালে তার চাকরি হয়। নূর হোসেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুল ইসলামের গাড়ি চালাতেন। সম্প্রতি ছেলেকে চাকরিচ্যুত করা হলে ইসমাইল হোসেন মানসিকভাবে ব্যথিত হন।
৮০ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। বুধবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন ছেলেরা। সেখানেই তিনি আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন। এ সময় ইসমাইল হোসেন তার কথাগুলো ভাইয়ের ছেলে এ এস এম জাকারিয়াকে চিঠি আকারে লিখতে বলেন। এই চিঠি হুইপ ইকবালুর রহিমের কাছে পৌঁছে দেয়ারও নির্দেশনা দেন তিনি।
চিঠিতে ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করেন, তার ছেলে নূর হোসেনকে দিয়ে ভূমি কমিশনার বাসার রান্নাসহ বিভিন্ন কাজ করাতেন। সামান্য কারণেই কমিশনার ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। অফিসে যেতে দেরি করায় এবং বাসার শৌচাগার পরিষ্কার করতে রাজি না হওয়ায় গত আগস্টে তার কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়া হয়। তিনি ঈদগাহ বস্তি এলাকায় সরকারি একটি পরিত্যক্ত বাসায় থাকতেন। পরে সেখান থেকেও নূর হোসেনকে বের করে দেয়া হয়। চাকরির পর বাসা থেকেও উচ্ছেদ হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেশ কষ্টে দিন যাপন করছেন নূর হোসেন।
এ বিষয়ে হুইপ ইকবালুর রহিম গণমাধ্যমকে বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন মৃত্যু প্রত্যাশিত নয়। বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন, তবে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের লেখা চিঠি এখনও তার হাতে এসে পৌঁছেনি। চিঠি পেলে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন।