ভয়ংকার সন্ত্রাসী সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক : এক ডজন দেহরক্ষী ছিল তার

পাঠক: কখনও প্রাইভেট কারে, কখনও হোন্ডায়। কিবা রাত কিবা দিন। অন্তত ১২ জন বডি গার্ড নিয়ে যার দাপিয়ে বেড়ানো, তাদেরই দু’জন পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে প্রাণ হারানোয় বড়ই কষ্ট পেয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান। নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, তোদের যে এভাবে হারাতে হবে তা ভাবতেও পারিনি। তাদের জন্য দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, আল্লাহ যেনো তাদের বেহশতবাসী করেন। শনিবার সকালে এই স্ট্যাটাস দেওয়ার পর তা ভাইরাল হয়ে যায়। ছবিতে সৈয়দ সাদিকুর রহমানের দুই পাশে থেকে তাদের জীবদ্দশায় পোজ দেন নিহত মুনজিতপুরের ময়নুল ইসলামের ছেলে মাহমুদুর রহমান দীপ (২৫) ও কালিগঞ্জের চাম্পাফুল ইউনিয়নের উজিরপুর গ্রামের সবুর সরদারের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৮)।
সৈয়দ সাদিকুর রহমানের দেহরক্ষী হিসেবে বহুল আলোচিত ও পরিচিত এই দু’যুবকের বিরুদ্ধে গত ৩১ অক্টোবর কালিগঞ্জের কাউখালিতে বিকাশ এজেন্টকে গুলি করে মোটর সাইকেল থামিয়ে ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের আসামীভূক্ত করে। গত বৃহস্পতিবার তাদেরকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার রাতে দীপ ও সাইফুলকে নিয়ে পুলিশ শহরের কামাননগরে বাইপাস সড়কের ধারে তাদের গোপন ডেরায় অন্য সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে নিয়ে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এসময় দুইপক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হয় দীপ ও সাইফুল। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ দুটি দেশি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলি জব্দ করেছে।
দীপ ও সাইফুলের কথিত গডফাদার সৈয়দ সাদিকুর রহমান তার অন্যান্য সব দেহরক্ষীর হাতে বেআইনি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা এই শহর ও শহরের অদূরে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগেও ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে শহরে নিয়ে আসা একটি স্বর্ণের চালান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাদিকুর বাহিনী চোরাচালানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গত ৩০ মে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সাতক্ষীরার সাংবাদিকদের রক্তাক্ত জখম করে দম্ভের সাথে চলে গিয়েছিল। এই হামলাকারীদের মধ্যে ছিল সাদিকুরের বডিগার্ড দীপ ও সাইফুলসহ কয়েকজন। জেলাব্যাপী সকল টেন্ডারের ভাগ বসিয়ে আসছে সাদিকুর বাহিনী। জোরপূর্বক টেন্ডারবাক্স ছিনতাই অথবা সমঝোতার মাধ্যমে ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে বহুদিনের। দুই বছর আগে জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি পদ লাভের পর সাদিকুর সকল স্থানে তার পরিচয় জানিয়ে দিয়ে তাকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার কথা বলে দেন। শহর ও শহরতলীর বহুজনের জমি দখলেও ওস্তাদের ভূমিকা পালন করেন সাদিকুল ও তার বাহিনী। সম্প্রতি শহরের বাইপাস সড়কের ধারে পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশির পৈতৃক জমি দখল করতে গিয়েছিল সাদিক বাহিনী। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ায় তারা বাধা পেয়ে ফিরে আসে সেখান থেকে।
গত ৩ আগস্ট রাতে শহরতলীর মাছখোলায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির প্রয়াত সভাপতি আইউব আলির নি:সন্তান বিধবা স্ত্রী হোসনে আরার বাড়ির জমি চুক্তি ভিত্তিক দখলের জন্য রাত ১১টার দিকে সাদিকুর বাহিনী ছাত্রলীগের আরও কয়েক ক্যাডারকে নিয়ে সেখানে হামলা করে। এদের মধ্যে দীপ ও সাইফুলও ছিল। এ সময় ওই মেস বাড়িতে থাকা ছাত্রদের পাল্টা হামলায় সাদিকুর ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। এ সময় তার কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে আহত হন সাদিকুরের অনুসারী ছাত্রলীগের আজমীর হোসেন ফারাবি আহত হন। ফারাবি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেনের ছেলে। তবে তাদের লক্ষ্যবস্তু ভুল হওয়ায় গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে রাতেই তারা সেখান থেকে পালিয়ে আসে। এরপর সাদিকুর বাহিনী জমি দখল চেষ্টার ঘটনা চাপা দিয়ে প্রচার দেয় ওই বাড়িতে শিবিরের ক্যাডাররা নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের প্রতিহত করতে তার বাহিনী এই হামলা চালায়।
প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা অথবা তার অধিক সময় পর্যন্ত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সাদিকুরের মজমা বসে শহরের কামানগরের প্রাণি সম্পদ অফিসের আশপাশে। বছর খানেক আগে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মৎস্য ব্যবসায়ী আনারুল ইসলামকে ফোনে ডেকে পাঠায় সাদিকুর। প্রাণি সম্পদ অফিসের কাছে নিয়ে সাদিকুর তার কাছে দাবি করে মোটা অংকের চাঁদা। আতংকিত হয়ে আনারুল এক লাখ টাকারও বেশি দিয়ে রক্ষা পান। অবশেষে আওয়ামী লীগের পৌর কমিটিকে অবহিত করে তিনি এ বিষয়ে সাতক্ষীরা থানায় একটি মামলা করেন। এমনকি এ নিয়ে তিনি একটি প্রেস কনফারেন্সও করেন। কিন্তু সে মামলা ভস্মীভূত হয়ে যায় সাদিকুলের মাথার ছাদ সাতক্ষীরার একজন জনপ্রতিনিধির হুংকারের মুখে। সাদিক বাহিনীর সদস্য সাইফুল ইসলাম ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি স্কুলের দপ্তরি মুন্সিপাড়ার সোহাগকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সাইফুল সাদিকুরের লোক এবং সোহাগও সাদিকুরের অনুসারী হওয়ায় এই হত্যার ঘটনাটি বেশিদূর গড়াতে পারেনি। সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে তা চাপা পড়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে দুই বছর আগে জেলা ছাত্রলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদিকুর রহমান ছাত্রলীগের কোন ওয়ার্ডেরও সদস্য ছিলেন না। অভিযোগ পাওয়া যায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ছাত্রলীগের তৎকালিন কেন্দ্রিয় নেতাদের সন্তুষ্ট করে সাদিক এক বছর মেয়াদী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। এরই মধ্যে দুই বছর কেটে গেলেও আজ অবধি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে তার গাফিলতির অভিযোগ করেছেন সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাতটি উপজেলা ও একটি পৌর কমিটি বারবার ভাঙাগড়া করেছেন। টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন করে দেওয়ার পর ২/৩ মাস যেতেই ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে ফের নতুন কমিটি গঠন করেন তিনি। এজন্য নয়া কমিটির কাছ থেকে নতুন করে চাঁদা আদায় করেন তিনি। এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের নেতারা সাংবাদিকদের কাছে এমনকি কেন্দ্রেও বারবার অভিযোগ করে আসছেন। কমিটি ভাঙাগড়ার কাজে সাদিকুর ব্যবহার করেন হাতে লেখা একটি প্রেস রিলিজ।
জানা যায়, সৈয়দ সাদিকুর রহমান একজন বিবাহিত যুবক। তার স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের ২৬ মার্চ শহরের আলাউদ্দিন চত্ত্বরে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুবলীগের মনোয়ার হোসেন অনুকে ছুরিকাঘাত করে আহত করে সাদিকুরের দেহরক্ষী দীপ। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হলেও সাদিকুরের মাথার ছাদ জনপ্রতিনিধির মন্ত্রে সে অভিযোগও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাদিকুর মুনজিতপুরের জেলা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ হায়দার আলী তোতার ভাতিজা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তোতার বাড়ি থেকে একদল জুয়াড়ি ও জুয়ার সরঞ্জাম আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এদিকে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সাদিকুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার দুই আসামি আজিজুল ও শামীমকে পুলিশ জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
বিভন্ন তথ্য সূত্র জানিয়েছে, নিহত দেহরক্ষী সাইফুল সুলতানপুরে জনৈক আবুবকরের আত্মীয় হিসেবে তার বাড়িতে থাকতো। তা সত্ত্বেও শহরের মুন্সিপাড়ায় ফায়ার সার্ভিসের কাছে একটি ভাড়া বাড়ি রয়েছে সাইফুলের। সেখানে থাকে একাধিক তরুণী। সাইফুল তার বস সাদিকুরকে প্রায়ই নিয়ে যায় সেখানে। সেখানে বেশ আনন্দ ফূর্তিতে সময় কাটে তাদের।
তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান জানান, আমি অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় রয়েছি কয়েকদিন। দীপ ও সাইফুলের ঘটনা শুনে মর্মাহত হয়েছি। তারা তো আপনার দেহরক্ষী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেহরক্ষী তো বেতন ভাতা দিয়ে পুষতে হয়। ওরা দেহরক্ষী নয়। ওদের সাথে আমার সম্পর্ক ভাইয়ের মতো। তবে তারা কোনো ঘটনা বিশেষ করে বিকাশ এজেন্টের টাকা ছিনতাইয়ের সাথে তারা জড়িত কিনা এসব বিষয় আমার জানা নেই। মাছখোলায় আইউব আলির স্ত্রীর জমি দখলের সময় দীপ ও সাইফুল ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, আমার কোনো বাহিনী নেই। সাদিকুর বলেন, তার বিরুদ্ধে আরও যা যা বলা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয়। এ সবই অপপ্রচার।পত্রদূত

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।