সামিউল মনির, শ্যামনগর: আশা দিয়ে না মেরে একেবারে বনে প্রবেশ বন্ধ করে দিলেই আমরা বিকল্প কোন কাজ খোঁজতাম। এভাবে খেয়াল খুশিমত সুন্দরবনে যাওয়া আটকে দিলে আমাগো মত সহায় সম্বলহীন জেলেগো চুরি ডাকাতি ছাড়া কোন পথ খোলা থাকবে না।
উত্তেজিত কন্ঠে কথাগুলো বলেই চোখের পানি ছেড়ে দেয় দাতিনাখালী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী ফজের আলী। অল্পক্ষণবাদে নিজেকে সামলে নিয়ে শরীরে চাপানো ময়লাযুক্ত ফতুয়া দু’হাতে উঁচিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন দুই দিন ধরে অভুক্ত থাকার পর নিজের শারিরীক অবস্থা।
পেট ও পিঠ একাকার হয়ে গেছে বোঝানোর চেষ্টার পর ফজের আলী জানান, গেল মাসেও বনে যাওয়ার সুযোগ না দেয়ায় সাত সদস্যের পরিবারে চুলা জ¦ালানো বন্ধ হয়েছে আরও আগে। কয়েকদিন ধরে সবজী বিক্রেতা ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় নিয়ে কোন রকমে আধপেটা খেয়ে দিন পার করতিছি। আশা ছিল বাইশ দিনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বনে ঢুকতি পারলি তিন সপ্তাহের ঋণের পরিমানটা হালকা করবো। কিন্তু হঠাৎ করেই আরও বার দিনের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।
ভিন্নতা নেই ফজের আলীর প্রতিবেশী আজিজুল সরদার, নীলডুমুর গ্রামের বাবুল হাসান, মোসলেম গাজী, বিলাল হোসেন ও হরিণগরের পরিমল মন্ডলের বক্তব্যে।
বাবুল হাসান ও পরিমল বলেন, আমাগো পেটে লাথি মেরে কার কি সুবিধা জানিনে, তবে পরিবার পরিজন নিয়ে নিদারুন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে আছি। অন্য আরও অনেকের মত এ দুই জেলের দাবি সুন্দরবনে ইলিশ না মেলা সত্ত্বেও ইলিশ সংরক্ষণের অজুহাতে সেপ্টেম্বরের সাত/আট তারিখের পর হতে মাছ কাঁকড়া শিকারের জন্য তাদের বনে ঢুকতে দেয়া হয়নি। অথচ ইলিশ শিকার বন্ধের সময়ে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা জেলেদের সরকারি বিশেষ প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হলেও সেক্ষেত্রে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর আগে পুরো জুলাই এবং আগষ্ট মাসও সুন্দরবনাঞ্চলের জেলেদের মাছ কাঁকড়া শিকারের জন্য বনে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়নি বলেও জানান তারা।
ইলিশ শিকারী না হয়েও আমরা মাছ কাঁকড়া ধরতি বনে যেতে পারিনি, অথচ নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা জেলেদের জন্য বিশেষ সরকারি সুবিধাও আমরা পায়নি- বলে জানালেন কালিঞ্চি গ্রামের হরশিদ আর গোলাখালীর বাবুরামসহ অসংখ্য জেলে। তাদের অভিযোগ বনবিভাগ একের পর এক নানা অজুহাতে জেলেদের বনে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়ে নিজস্ব কিছু কোম্পানী ও লোকজন দিয়ে যথারীতি মাছ কাঁকড়া শিকার করাচ্ছে।
এমনকি নিষেধাজ্ঞার সুযোগকে কজে লাগিয়ে চুক্তির ভিত্তিতেও কতিপয় দুর্নীতিবাজ বন কর্মকতা অনেক চিহ্নিত জেলেকে সুন্দরবনে ঢুকতে সহায়তা করছে বলেও অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য জেলে।
আবুল কাশেম, মইনুল শেখ, হযরত আলীসহ অসংখ্য জেলের অভিযোগ ইলিশ সংরক্ষণের নিষেধাজ্ঞা কাটতে না কাটতে এবার রাস মেলার নামে তাদেরকে সুন্দরবনে যাওয়া আটকে দেয়া হয়েছে উদ্দেশ্যমুলকভাবে। একইভাবে ইতোপুর্বে গোটা সেপ্টেম্বর মাসজুড়েই ইলিশ সংরক্ষণের নামে বনবিভাগ কেবলমাত্র নিজস্ব সিদ্ধান্তে এতাদঞ্চলের জেলেদের বনে প্রবেশের সুযোগ দেয়নি বলেও তাদের অভিযোগ।
এদিকে বনবিভাগের এমন হঠকারি সিদ্ধান্তের কারনে সুন্দরবনাঞ্চলের জেলে পল্লীতে রীতিমত হাহাকার শুরু হয়েছে। নুন আনতে পানা ফুরোনোর মতো অবস্থা পরিবারগুলোতে নুতন এ নিষেধাজ্ঞা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এতদিন ধার দেনা করে অর্ধাহারে অনাহারে কাটানো পরিবারগুলো আশায় ছিল নভেম্বরেই ঋণ শোধ দিয়ে কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুম জানুয়ারী ফেব্রুয়ারীর জন্য কিছু সঞ্চয় করবে। কিন্তু ইলিশের নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা শেষ হতে না হতেই আবারও রাস মেলার অজুহাতে তাদেরকে বনে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করায় ‘না খেয়ে মরার’ উপক্রম হয়েছে বলে জানান তারা।
একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে দাবি করে উপকুলীয় জনপদের হাজারও জেলে জানিয়েছে আইলার পর থেকে এলাকায় কোন কাজ নেই। সুন্দরবন থেকে মাছ কাঁকড়া শিকার করেই তারা নিজেদের জীবন-জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে বনবিভাগের একের পর এক অযৌক্তিক সিদ্ধান্তে তারা রীতিমত হতবিহ্বল। এলাকায় কাজ না থাকায় পরিবার পরিজন রেখে অনেকে শহরাঞ্চল কিংবা দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজের সন্ধানে গেলেও ভারী কাজে অক্ষম এবং বয়স্ক জেলেসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা মারতা¦ক সমস্যার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
এমনকি স্কুল কলেজে পড়–য়া এসব জেলে পরিবারের অনেক সন্তানের বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষা শুরুর মৌসুম এসে যাওয়ার বিপরীতে পরিবার প্রধানের আয় রোজগার বন্ধ থাকার বিষয়টি তাদের লেখাপড়াতেও প্রভাব ফেলছে বলেও জানান অনেকে।
দাতিনাখালীর আকবর হোসেন ও ফয়সালসহ অনেকে জানান পরিবারের অবস্থা দিন এনে দিন খাওয়ার মত হওয়ায় মহাজনের থেকে চড়াসুদে ঋণ আর দাদন ব্যবসীর থেকে অগ্রীম টাকা নিয়ে সংসার চালাতি হয়েছে। ইচ্ছা ছিল নিষেধাজ্ঞা শেষে অক্টোবরের শেষ দিন হতে বনে যাওয়ার পর শিকারকৃত মাছ/কাঁকড়া দিয়ে ঋনের বোঝা কমাবো। কিন্তু সব স্বপ্নকে ধুলিস্বাৎ করে দিয়ে বনবিভাগ আবারও বার দিনের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়ে মুলত আমাগো পেটে লাথি মেরেছে।
তবে ইলিশের সংরক্ষনকালে নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কতিপয় দুর্নীতিবাঁজ বনকর্মীর সহায়তায় মুষ্টিমেয় জেলে সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রেখেছিলেন বলে তথ্য দেন আনিছুজ্জামান নামের এক সংবাদকর্মীসহ স্থানীয় বেশ কিছু জেলে। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও গত তিন দিনে রাতের আধারে হরিনগর এলাকা দিয়ে নওয়াবেঁকীতে একাধিক কাঁকড়ার চালান যাওয়ার তথ্য দেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা দাবি রেখে বলেন, লুকিয়ে যদি গুটিকতক সুবিধাবাদী বনবিভাগের আনুকুল্য নিয়ে বনে যাওযার সুযোগ পায় তবে কেন উপকুলের তিরিশ হাজার জেলে দিনের পর দিন আয় রোজগারহীন থেকে পরিবারের সবাইকে নিয়ে না খেয়ে মরবে।
সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসরত জেলেদের অভিযোগ ভারতীয় সুন্দরবন সংলগ্ন নদীতে জেলেরা মাছ কাঁকড়া শিকার অব্যাহত রাখলেও অজ্ঞাত কারনে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাদের সুন্দরবনে প্রবেশকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
তাদের আরও অভিযোগ নিজেদের খেয়াল খুশিমত বনবিভাগ সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় তারা পুর্ব পুরুষের পেশায় জড়িত থেকে এখন অর্ধ্বাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে জেলেদের অভিযোগ সাগরকুলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া রাস মেলাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে বার দিনের এ নিষেধাজ্ঞা জারি বিশেষ কোন ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের দাবি ইতিপুর্বে রাস মেলার সময় অনেক পর্যটক মেলাস্থলে যাতায়াতের পথে সুন্দরবনের শিকার নিষিদ্ধ হরিণ শিকার করে সুন্দরবনে কর্মরত জেলেদের তথ্যের ভিত্তিতে আটক হয়েছে। অথচ ইলিশের নিষেধাজ্ঞা শেষ না হতেই আবারও রাস মেলাকে কেন্দ্র করে তাদের আয় রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়া হলো।
উল্লেখ্য সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এ উপকুলীয় জনপদে প্রায় তিরিশ হাজার পরিবার গড়ে উঠেছে। সুদীর্ঘকাল ধরেই যাদের সারা বছরের আয় উপার্জনের একমাত্র ক্ষেত্র বঙ্গপোসাগর তীরবর্তী সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীসমুহ।
যেখানে প্রাকৃতিকভাবে জম্মানো শত শত প্রজাতির মাছ ও কাঁকড়া শিকার করে জেলেরা আদিকাল থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে নিজেদের জীবন ও জীবিকা চালিয়ে নিচ্ছে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদী হতে মাছ কাঁকড়া সংগ্রহ আর তা বেচা বিক্রিসহ বাজারজাতকরণই যাদের সারা বছরের কাজ।
বার বার জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ বিধু¯্রুবা মন্ডল বলেন, ইলিশ মেলে না, তবুও সুন্দরবনে জেলেদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। এবার রাস মেলাকে কেন্দ্র করে জেলেদের উপর নিষেধাজ্ঞার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, এর চেয়ে সুন্দরবনে সারা বছরের জন্য জেলেদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার নোটিশ টানিয়ে দিলে বনকর্মীদের আর দৌড়াতে হতো না।
এবিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফারুক হোসেন জানান, সুন্দরবন এলাকায় ইলিশ না মেলার তথ্য জানা থাকা সত্ত্বেও বনবিভাগ যে কেন ঐ সময়ে জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তা তার নিজেরও বোধগম্য নয়। এমনকি ঐ সময়ে ইলিশ শিকারের সাথে জড়িত জেলেদের সরকারি প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হলেও সুন্দরবন অঞ্চলের জেলেরা সে সুবিধা না পাওয়াটা ছিল আরও দুঃখজনক।
এদিকে আবারও সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি নিয়ে জানতে চাইলে বুড়িগোয়ালীনি ষ্টেশন অফিসার আক্তারুজ্জামান বলেন, রাস মেলার জন্য জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যা আগামী ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য গত জুলাই এবং আগষ্ট দুই মাস মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মাত্র ৫/৬ দিন সুন্দরবনে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে আবার ইলিশ সংরক্ষণের অজুহাতে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ওই নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বনজীবিরা যখন বনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক সেই সময় আবারও নভেম্বরের ১২ তারিখ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। একইভাবে আগামী জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসেও কাঁকড়ার প্রজনন মৌসুমের কারনে জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বজায় করা হবে বলেও বনবিভাগ সুত্র নিশ্চিত করেছে।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …