আবু সাইদ বিশ্বাস:ক্রাইমর্বাতারিপোট: সাতক্ষীরা: চিংড়ি ঘেরে নোনা পানি উত্তোলনের প্রতিযোগীতায় নেমেছে সাতক্ষীরার উপকুলীয় অঞ্চলের প্রভাবশালী চিংড়ি চাষীরা। ফলে সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূল রক্ষার বাঁধের তলদেশ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে তারা জমিতে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করছে। শুধু শ্যামনগরকে ঘিরে থাকা উপকূল রক্ষা বাঁধে দুই হাজারেরও বেশি ওভার পাইপ বসিয়ে ঘেরে নোনা পানি উত্তলনের অভিযোগ উঠেছে। এতে জীববৈচিত্রসহ হুমকীর মুখে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ। এখুনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বসবাসের অনুপযোগী সাতক্ষীরাসহ হবে গোটা উপকূলীয় অঞ্চল।
ইত্যোমধ্যে ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অবস্থা নাজুক’ হওয়ার অভিযোগ এনে বাপাউবো এর ভেটখালী পওর শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বাদী হয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ (৩) ধারায় শ্যামনগর থানায় চার জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলা নং ২৩। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ প্রভাবশালীদের বাঁচাতে মাত্র চার জনের নামে মামলা করা হয়। তবে পানি উন্নবোর্ড কর্মকর্তা বলছে পর্যায়ক্রমে সকলের নামে মামলা করা হবে।
এ মামলায় শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম কৈখালী গ্রামের বাবলু গাজী, রাজ্জাক গাজী, ফজলুল হক ও মহিবুল্লাহ গাজীকে আসামী করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ/সাত জনকে অভিযুক্ত করে দায়ের হওয়া মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। ।
এদিকে পাউবোর বাঁধ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে অবৈধভাবে লবণ পানি উত্তোলনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। তারা অবৈধ পাইপ অপসারণ করে লবণ পানি মুক্ত পরিবেশে শান্তি পূর্ণভাবে ধান চাষ করতে চায়। তবে প্রভাবশালী ঘের মালিকরা জনসাধারণের এ দাবি উপেক্ষা করে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমঝোতা করে লবণ পানি উত্তোলন করছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকার কৃষকরা। এলাকাবাসীর দাবির সত্যতা নিরপণে এবার মাঠে নেমেছেন খোদ পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছে চিংড়ি চাষে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও জীববৈচিত্র্য চরম প্রভাব ফেলেছে। সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা আজ আর সবুজ নেই৷ সেখানে নেই কোনো গাছপালা, নদ-নদীতে নেই সুস্বাদু মাছ৷ নোনা পানির কারণে এলাকার মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত৷ খাদ্য অনিশ্চয়তাও বাড়ছে দিন দিন৷ আর এ সবের মূলে রয়েছে চিংড়ি চাষ ৷উপজেলার মুন্সিগঞ্জের দাতিনাখালি গ্রামের আব্দুস সামাদ জানান,এই এলাকার মানুষ মূলত পুকুরের পানি পান করতো৷ কিন্তু নোনা পানির প্রভবের কারণে পুকুরেও এখন আর মিঠা পানি পাওয়া যায় না৷ এমনকি ভূগর্ভাস্থ পানিও নোনা৷ এক সময় পুকুরগুলোর পাশাপাশি খালগুলো ছিল মিঠা পানির আধার৷ এখন সেগুলোও মরে গেছে৷ ফলে অনেক দূর থেকে, বহু কষ্ট করে নারীদের খাবার পানি বয়ে আনতে হচ্ছে৷ সিডর, আইলা এবং সবশেষে বয়েযাওয়া ঘুর্ণিঝড় বুলবুলে মিঠা পানির বেশিরভাগ উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। এরপও প্রভাবশালীরা উপকূল রক্ষার বাঁধের তলদেশ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে জমিতে নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ করছে। এতে উপকূল রক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তৃণী অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীরা বলছেন, নোনা পানির প্রভবে গোটা দক্ষিণ উপকূল থেকে ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে অন্তত ৬০ প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি৷ এছাড়াও চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন৷ কৃষিজমি চাষের অনুপোযোগী হওয়ায় গত তিন দশকে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে বাইরে পাড়ি জমিয়েছে৷ দেশও ত্যাগ করেছেন অনেকে৷
শ্যামনগরে বসবাসরত আরাফাত হোসেন। জনৈক আফছার মাষ্টারের নিকট থেকে দুই বছরের জন্য ডিড নিয়ে পঞ্চাশ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। ওই চিংড়ি ঘেরটির উপর স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী মহলের দৃষ্টি পড়ায় তারা পাউবো কর্তৃপক্ষকে ভুল বুঝিয়ে তাদেরকে হয়রানী করতে হামলা মামলার ভয় দেখাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, জনৈক সওকাত সরদার ও তার লোকজন পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে তাদের হয়রানী করছেন।
এদিকে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে ও সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় পশ্চিম কৈখালী এলাকাতে বন্যা নিয়ন্ত্রন বা উপকুল রক্ষা বাঁধে অসংখ্য ওভার পাইপ যথাস্থানে রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন স্থানে রীতিমত বাঁধ কেটে পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু এসব ব্যক্তিদের কাউকে পাউবোর পক্ষ থেকে দায়েরকৃত মামলায় আসামী না করাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হুমকির মুখে পড়বে উপকূলীয় অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য৷
সাতক্ষীরা পানিউন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফউজ্জামান খান জানান, যারা প্রভাব খাটিয়ে উপকূল রক্ষার বাঁধের তলদেশ ছিদ্র করে পাইপ বসিয়ে নোনা পানি তুলে ক্ষতি সাধণ করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।