ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ সাতক্ষীরার: যে গতিতে গুজব ছড়ানো হলো, তার চেয়ে দ্রুত গতিতে প্রশাসনের এ্যাকশান শুরু হলো। ফলে পিয়াজের মত লবণ সংকট স্থায়ীত্ব লাভ করতে পারেনি। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সারা দেশের ন্যায় সাতক্ষীরায়ও ছড়িয়ে পড়ে লবণ গুজব। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই গুজব ছড়িয়ে পড়লে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সবাই যে যার অবস্থান থেকে নেমে পড়েন গুজব ঠেকাতে। জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমানসহ জেলার ৭টি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও ৮টি থানার অফিসার ইনচার্জের নেতৃত্বে পুলিশ মাইকিং করে গুজবের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালায়। থেমে ছিলেন না গণমাধ্যম কর্মীরাও। ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বাজারে বাজারে গিয়ে গুজব বিরোধী প্রচার চালিয়ে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা সাধারণকে সতর্ক করেন। স্থানীয় পর্যায়ের অনেক জনপ্রতিনিধিকেও প্রচারে অংশ নিতে দেখা যায়। বেশি দামে ও পরিমাণে লবণ বিক্রি ও ক্রয় করলে উভয়কে শাস্তির আওতায় আনা হয়। জেলা গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যেকটি ইউনিট সার্বক্ষণিক মাঠে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। যে কারণে গুজবের ডালপালা গজানোর আগেই প্রশাসনের তৎপরতায় মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এদিকে সরকারের আদেশ অমান্য করে লবণের কৃত্রিম সংকট ও গুজব সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধির অপরাধে সাতক্ষীরায় ৫ ব্যবসায়ীকে ১ মাসের জেল এবং অপর ৭ জনের ২৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। মঙ্গলবার রাতে শহরের পুরাতন সাতক্ষীরা, সুলতানপুর বড়বাজার, মিলবাজার ও সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর বাজার থেকে তাদের আটক এ সাজা প্রদান করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী ও সদর ভূমি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। সাজাপ্রাপ্ত ৫জন হলেন, সদর উপজেলার ব্রহ্মরাজপুর উমরাপাড়া এলাকার ইমাম হোসেন, মেহেদি হাসান, ইয়াছিন মোড়ল, পুরাতন সাতক্ষীরা এলাকার মোস্তাফিজুর রহমান ও মিজানুর রহমান। অন্য ৭ জনকে ২৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এদিকে, লবণের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে শহরের সুলতানপুর বড়বাজারসহ বিভিন্ন মুদি দোকানে।
কলারোয়া থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি আরিফ মাহমুদ জানান, লবণের দাম বৃদ্ধির গুজবে মঙ্গলবার বিকেল থেকে হুলস্থুল কান্ড ঘটে কলারোয়া বাজারে। সন্ধ্যার পরে রীতিমতো জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ প্রশাসনের সক্রিয় হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন, সমাধানও হয় পরপরই। গুজবরোধে তাৎক্ষণিক মাইকিংও করা হয়। সাময়িক আটক করা হয় কয়েকজন ব্যবসায়ীকেও। ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা করা হয়েছে এক ব্যবসায়ীকে। কলারোয়া টিএন্ডটি রোডের মেসার্স হারুন স্টোর থেকে ভ্যানভর্তি লবণ বেশি মূল্যে কিনে উপজেলার কলাটুপি বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানটি আটক করে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। আটককৃত ওই ভ্যানের চালক জানান- প্যাকেট লবণগুলো কলাটুপি বাজারের ব্যবসায়ী ফিরোজ হোসেনের।
এদিকে, উপজেলার সরসকাটি, গয়ড়া, বালিয়াডাঙ্গা, কাজিরহাট, সোনাবাড়িয়া, খোরদোসহ বিভিন্ন বাজারে অনুরূপ দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।
লবণের দাম বৃদ্ধির গুজব রোধে সজাগ থাকতে তাৎক্ষণিক কলারোয়া বাজারের বিভিন্ন দোকানে দোকানে গিয়ে বিচলিত না হওয়ার আহবান জানান কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু, ভাইস চেয়ারম্যান শাহানাজ নাজনীন খুকু প্রমুখ।
উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নের খোরদো বাজারে ফারুক ট্রেডার্সে ন্যায্যমূল্যের অতিরিক্ত দামে লবন বিক্রয়ের অপরাধে ভোক্তা অধিকার আইনে ওই দোকানের মালিক ফারুক হোসেনকে ৫ হাজার টাকা নগদ জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ইউএনও সেলিম শাহনেওয়াজ। কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আরএম সেলিম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘কলারোয়াতে লবনের কোন ঘাটতি নেই। কৃত্রিম সংকট তৈরী করলে অথবা কারসাজি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
দেবহাটা থেকে সংবাদদাতা আরিফুল ইসলাম আরিফ জানান, দেবহাটায় অতিরিক্ত দামে লবণ ক্রয়-বিক্রয় করায় লবণের ভ্যানসহ ১ জন বিক্রেতা ও ২জন ক্রেতাকে আটক করেছে পুলিশ। আটক কৃতরা হলেন বহেরা বাজার এলাকার ক্রেতা আব্দুল লতিফের পুত্র আক্তারুজ্জামান, নাংলা বাজার এলাকার বিক্রেতা আব্দুর রাজ্জাকের পুত্র ইব্রাহিম, ক্রেতা আহাদ আলীর পুত্র রফিকুল। এছাড়া সখিপুর বাজারের দয়াল ও ইয়াকুবের দোকান থেকে টাউনশ্রীপুর সাঈদের দোকানে ভ্যান বোঝায় করে লবণ নিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানসহ উক্ত লবণ জব্দ করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এব্যাপারে দেবহাটা থানার অফিসার ইনচার্জ বিপ্লব কুমার সাহা বলেন, অতিরিক্ত দামে লবণ ক্রয়-বিক্রয় করায় লবণের ভ্যানসহ ৩জনকে আটক করা হয়েছে।
শ্যামনগর থেকে সামিউল মনির জানান, নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় বেশি দামে লবণ বিক্রয় করায় শ্যামনগর উপজেলা সদরের লক্ষ্মীপুর বাজারে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মো. নাহিদ হাসান খান। অভিযানকালে ১৫ টাকা মূল্যমানের লবণ দ্বিগুণ দামে বিক্রি করায় শ্রীকৃষ্ণ বাণিজ্য বিতান এবং সঞ্জয় স্টোরে অভিযান চালানো হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর লবণের দাম বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে এমন গুজব ছড়িয়ে অজ্ঞাত স্থান থেকে নিয়ে আসা দুই ভ্যান লবণ ৪০ থেকে ৬০ টাকায় প্রতি কেজি হিসেবে বিক্রয় করে। একপর্যায়ে লক্ষীপুর বাজারের ভ্রাম্যমাণ আদালতের পরিচালিত অভিযানের বিষয়ে খবর পেয়ে হাসান মোড়ল দোকান বন্ধ করে চলে যায়। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে নকিপুর বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী একই ধরনের ঘটনা ঘটে ছড়িয়ে পড়া এই গুজবের সুযোগ নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে লবণ বিক্রয় করে।
একই উপজেলার মনির শামীম জানান, শ্যামনগর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) নাহিদ হাসানের নেতৃত্বে শ্যামনগর থানা পুলিশের সহয়তায় ভ্রাম্যমান অভিযান পরিচালনা করে শ্যামনগর সদরের প্রতিটি দোকানে অভিযান চালিয়ে কেজি প্রতি ১৫০ টাকায় লবণ বিক্রি করার দায়ে ১ ব্যবসায়ীকে ১০০০ টাকা জরিমান করেন।
ঝাউডাঙ্গা থেকে মনিরুল ইসলাম মনি জানান, মঙ্গলবার বিকাল থেকে ক্রেতারা বাজার থেকে লবণ কিনতে ভীড় করে। অধিকাংশ দোকানে লবণ কেনার জন্য ক্রেতারা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান।
কদমতলা থেকে সেলিম হোসেন জানান, মঙ্গলবার থেকে লবণ বস্তা প্রতি ৩০/৪০ টাকা হারে দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি ২৮ থেকে ৩০ টাকা লবণ বিক্রি করা হচ্ছে বলে এক ব্যবসায়ীরা জানান। তবে এদিকে কদমতলা বাজারে মুদি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৫০/৬০ টাকা করে লবণ কিনছে বলে ক্রেতারা জানান।
পাটকেলঘাটা থেকে মুজিবুর রহমান জানান, সেখানে ৯ জন ব্যবসায়ির কাছ থেকে ৪৮ হাজার টাকা জরিমানা ও এক ক্রেতাকে এমমাসের কারাদ- দেওয়া হয়েছে।
তালা ইলিয়াস হোসেন জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লবণের দাম বৃদ্ধির আতংক ছড়িয়ে পড়ে। লবণ ক্রয়ের জন্য দোকানে শতশত মানুষের লাইন পড়ে। ৩০ টাকার লবন ৫০/৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি জন ১০/২০ কেজি পর্যন্ত লবণ ক্রয় করছে। এমন আতংক ছড়িয়ে পড়ায় মাঠে নেমেছে তালা ইউএনও ইকবাল হোসেন। আটক করা হয়েছে ইয়াছিন নামের এক দোকানদারকে। সিলগালা করা হয়েছে ব্যবসায়ীর গোডাউন। তালা ইউএনও মো. ইকবাল হোসেন বলেন, দেশে কোন লবণ সংকট নেই। এটা নিছক একটা গুজব। এমন গুজবে যারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি লবণ কিনছেন তাদের কেউ আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি সকলকে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তালা, শাহপুর ও তেঁতুলিয়া বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজারে তালা থানা পুলিশকে সাথে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার স্থানীয় জনসাধারনকে সচেতন করার লক্ষ্যে মাইকেও প্রচার করছেন।
কালিগঞ্জ থেকে নিয়াজ কওছার তুহিন জানান, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে আকষ্মিক ভাবে লবনের মূল্য ১ শ’ টাকা থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়। মাত্র ২০ টাকা কেজি’র সাধারণ লবন ও ৩৫ টাকার প্রক্রিয়াজাত লবণ উপজেলার সর্বত্র ১শ’ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে জানতে পেরে অনেকেই পাশর্^বর্তী দোকান বা বাজারে যেয়ে হুড়োহুড়ি করে লবণ কিনতে শুরু করেন। এসব বিষয়ে জানতে পেরে কালিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) দোলোয়ার হুসেন পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে অসৎ ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেয়া হয়। দেশে পর্যাপ্ত লবণের মজুদ আছে বলে আশ^স্ত করা হয় জনসাধারণকে। এছাড়াও মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ পাওয়ার পর সেসব এলাকায় পুলিশ সদস্যদের পাঠিয়ে ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম তদারকি করা হয়।
এদিকে লবন অস্বাভাবিক বেশী দরে বিক্রি হচ্ছে এমন খবর জানার সাথে সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোজাম্মেল হক রাসেল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এসময় তিনি বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত দোকান মালিককে মজুদকৃত লবন ক্রেতাদের মাঝে চাহিদা অনুযায়ী বিক্রির নির্দেশ দেন। অনেকে দোকান বন্ধ করে চলে যায়। অভিযানের বিষয়টি প্রচার হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানা গেছে।