ইব্রাহিম বাহারী: সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত। পূর্বে পিরোজপুর জেলার মঠবাবাড়িয়া ও বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানা। পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বাংলার শ্যামনগর থানা, খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত। সুন্দরবনের নামকরণে আছে অনেক মতপার্থক্য। তবে সুন্দরী গাছের প্রাধান্যের কারণে সুন্দরবন নামের উৎপত্তি বলেই এটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত।
সুন্দরবন এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অরণ্যের নাম। সুন্দরবনের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসপটে ভেসে ওঠে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি এই সুন্দরবন। বিশ্বের একমাত্র একক বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বনভূমি এই সুন্দরবন। সুন্দরবন মানুষের সৃষ্ট কোনো বন নয়। এ বন প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। বনের গাছে ফল পেকে মাটিতে পড়ে। জোয়ারের পানিতে সেই ফল বনের সব জায়গায় পৌঁছে যায়। ফলটি যেখানে স্থায়ীভাবে আটকে যায় সেখানেই নতুন চারা গজায়। গোটা সুন্দরবন এই প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে উঠেছে। বনের মহানায়ক রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এই রয়েল বেঙ্গলের কারণে সুন্দরবনের নাম বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের সংস্কৃতি, জাতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। ছোট ছোট পশমে দেহ আবৃত। হিং¯্র মাংসাশী প্রাণি। মাথার ওপর ও নিচের অংশ শরীর লেজ ও বুকের রং উজ্জ্বল বাদামি। তার ওপর কালচে ডোরাকাটা দাগ। সাধারণত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ৯-১১ মিটার লম্বা হতে পারে, ২-৩ কুইন্টাল ওজন হয়। এক এক থাবায় ১৮ জন পুরুষের সমপরিমাণ শক্তি আছে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখেছেন সুস্থ পরিবেশ, বসবাস, খাদ্য চলাফেরার কারণে সুন্দরবনের এই প্রাণী দুর্লভ প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে।
বাঘের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৮২ সালের দিকে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছিল ৪২৫টি। ১৯৯৩ সালে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫০-৪০০।
এ তথ্য পাওয়া গেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে। লবণাক্ততাজনিত পানি ও অজ্ঞাত রোগে গত দশ বছরে অন্তত ৩১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। বন কর্মকর্তারা বলেছেন, ময়না তদন্তে দেখা গেছে লিভার নষ্টজনিত কারণে এসব বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তাছাড়া কিছু অসাধু শিকারী হরিণ শিকারের নামে বাঘ শিকার করে। বাঘের চামড়া প্রচুর মূল্যে বিক্রয় করার জন্য। গে¬াবাল টাইগার ফোরামের সভায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বাঘের সংখ্যা ৩৬২। সঠিকভাবে নিরূপণ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বিংশ শতকের শুরুতে ভারতে বাঘের মোট সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। ১৯৬০ সালের শুরুতে তা কমে দাঁড়ায় চার হাজারে। ১৯৯৩ সালে বাঘ শুমারিতে বাঘের সংখ্যা তিন হাজার সাত শ’ পঞ্চাশ বলে উলে¬খ করেছে। প্রাণি জগতের মধ্যে বাঘ সবচেয়ে অরক্ষিত। ১৯৯৭ সালে এক বেসরকারি হিসাবে বাঘের সংখ্যা তিন হাজারের মধ্যে উল্লে¬খ করেছে।
এর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২০২০ সালের মধ্যে বাঘ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। তবে প্রত্যন্ত কয়েকটি স্থানে একটি দু’টি বাঘ হয়তো থেকে যাবে।
সুন্দরবন আমাদের গর্ব, আমাদের গৌরব। এ বনের প্রধান উদ্ভিদগুলোর মধ্যে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, ধুধুল, গোল, বাইন, হেতালী, হিন্দল, কেওড়া, কিরপে, কাঁকড়া, চান্তাল, দেবদাস, বনলেবু, খোলশে, বাবলে, গর্জন, খড়, নাট্রে, গিলে, হতেশ, হুদা, শেওলা, বনঝাউ, নিষিন্দা, তুড়ক স্বর্ণলতা, কেশুন, কেশফুল, মহাসমুদ্র, রাখাল, শোশা, ঢোল সমুদ্র, গুল্মলতা, গুলঞ্চলতা, বনচান্তাল, গঙ্গালতা, জানা গর্জন, কাউফল, পিচে গড়া, কেয়া কাঁটা, গাংঝাপা, বনচামেলি, অনন্তমূল, হরগুজা, টকসিন্দুর উল্লেখযোগ্য।
মাছে ভাতে বাঙালি এই কথার সাথেও রয়েছে সুন্দরবনের নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের প্রাণিজ প্রোটিনের ৮০% আসে মাছ থেকে। বনের ভেতরের বিভিন্ন খাল, খাড়াই থেকে আহরিত হয় প্রচুর মাছ। মাছগুলোর মধ্যে কিছু নাম নথিবদ্ধ করা যায় যেমন ভেটকী, বাইন, পারসে, পাঙ্গাস, গুলে, পায়রা, দাতনে, মেইদ, খর খুল¬া, তেড়ে, সিলেট, বগি, ফেসা, আমাদি, ভাঙগাল, নুচো, নিহাড়ী, রয়না, টেপা, এজে, জাবা, রেখা, রূপচাঁদা, কৈবল, বাঁশপাতা, টেংরা, সাগর কড়া, আমলেট, কাকশেল, ইলিশ, পান খাকী, ভোলা, তপসে, চেঙ্গুগুলে, চরশোধা, চ্যাটাবেলে, এক চোটে, বীরগুন, ডগরি, কালোভোমর, সাগর তোড়া, কাঁকড়া ভাঙ্গা, ভাঙ্গনা, সাতহেতে, জাবা, মেনুমাছ, খরবা, গাবদানা, সাগর কৈ উল্লে-খযোগ্য।
সুন্দরবনের পরিবেশকে আরো সুন্দর করেছে বিভিন্ন ধরনের প্রাণি ও পাখি যা পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। প্রাণিগুলোর মধ্যে বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর, গুলবাহার, শিয়াল, বনবিড়াল, বাদুড়, ভোঁদড়, শুশুক, বেজী উলে¬খযোগ্য। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণিগুলোর মধ্যে কুমির, গুইসাপ, কেউটে সাপ, গিরগিটি, চন্দ্রবোড়া, গোখরা, তক্ষক ও কচ্ছপ সকলের কাছে পরিচিত।
পাখিদের মধ্যে সুন্দরবনে যাদের দেখা যায়-বক, বাজশঙ্কল, শালিক, ঘুঘু, টিয়া, কাক, গাংচিল, বাটাং, ঈগল, শকুন, চিল, ডাহুক, কোড়া, বনমোরগ, মদনটাক, গগন ধাড়ী, মাছরাঙা, হলদে পাখি, কানা বক, টককা, টুনটুনি, বাঁশকোয়া, হুতোম পেঁচা, পানকৌড়ি, কাঠঠোকরা, বালিহাঁস। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য সম্পদে সমৃদ্ধ একটি ম্যানগ্রোভ বন। এ বনে রয়েছে অন্তত ৫ হাজার প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ, ৫ শ’ প্রজাতির গাছ, ১৮ শ’ প্রজাতির উভচর, ১২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭৯ প্রজাতির পাখি আর ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি। একাধিকবার সুন্দরবনে গিয়েছি, দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি প্রাকৃতিক এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে। বিশ্ববিখ্যাত এ বন কেবল এ দেশের সম্পদ নয়। এ বন বিশ্বের সম্পদ। আমরা নিজেরা নষ্ট না করলে এ বন শত বছরেও নষ্ট হবে না। এর গৌরব, সৌন্দর্য, প্রাচুর্য অক্ষুণœ রাখার জন্য আমাদের অঙ্গীকারই যথেষ্ট। সৌন্দর্য আর ভয় এখানে একসাথে বিরাজ করে। আর বনের এক অজানা আসনে বসে রহস্যময়ী বনবিবি সুখ-দুঃখের বাঁশি বাজায়। লেখক : সম্পাদক, বাঁধনহারা, কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা