সাতক্ষীরার মুকুটহীন সম্প্রাট ছাত্রলীগ সম্পাদক সাদিক

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ: সাতক্ষীরা  :সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার মুকুটহীন সম্প্রাট জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিক। কখনও প্রাইভেট কারে, কখনও হোন্ডায়। কিবা রাত কিবা দিন। অন্তত ১২ জন বডি গার্ড সবসময় তার। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গোটা সাতক্ষীরায়  ত্রাসের রাজস্ত কায়েম করেছে।
মাত্র দুই বছর আগে জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারি পদ লাভের পর সাদিকুর সকল স্থানে তার পরিচয় জানিয়ে দিয়ে তাকে নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার কথা বলে দেন। গড়ে তোলেন সাদিক বাহিনী।
দুই বছর আগে জেলা ছাত্রলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সাদিকুর রহমান ছাত্রলীগের কোন ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন না। অভিযোগ পাওয়া যায় ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ছাত্রলীগের তৎকালিন কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্তুষ্ট করে সাদিক এক বছর মেয়াদী কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন। এরই মধ্যে দুই বছর কেটে গেলেও আজ অবধি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি।
সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাাফিজুর রহমান জানান,সাতক্ষীরায় বিকাশ এজেন্টের ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের মুল হোতা (মাস্টারমাইন্ড) জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। রোববার সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান তার সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্র্রিফিংয়ে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, টাকা ছিনতাই ঘটনার সাথে জড়িত মোট নয়জনের সাতজনকে আটক করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুই আসামি সাইফুল ইসলাম ও মামুনুর রহমান দ্বীপ পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। দু’জন আসামি আজিজুর ও সামী হাসান সোহান আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ছিসতাইয়ের ঘটনায় সাদিকের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন বলে তিনি জানান।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, গত ৩১ অক্টোবর কালিগঞ্জ উপজেলার পাওখালি থেকে বিকাশের দুই এজেন্টকে গুলি করে মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে ২৬ লাখ টাকা ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় সাইফুল ও দ্বীপকে গ্রেফতার করা হলে তারাও নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে জানায় এই ছিনতাইয়ের মুল হোতা (মাস্টারমাইন্ড) জেলা ছাত্র লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান। পরে তাদের কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র, গুলি, দুটি মোটর সাইকেল এবং নগদ টাকা জব্দ করা হয়।
পুলিশ সুপার আরো জানান সাইফুল ও দ্বীপ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও সৈয়দ সাদিকুর রহমান পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সাদিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে পৃথক একটি মামলা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত তিনজনকে পুলিশ এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করছে জানিয়ে তাদেরকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।
সম্প্রতি শহরের বাইপাস সড়কের ধারে পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশির পৈতৃক জমি দখল করতে যান।
গত ৩ আগস্ট রাতে শহরতলীর মাছখোলায় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির প্রয়াত সভাপতি আইউব আলির নি:সন্তান বিধবা স্ত্রী হোসনে আরার বাড়ির জমি চুক্তি ভিত্তিক দখলের জন্য রাত ১১টার দিকে সাদিকুর বাহিনী ছাত্রলীগের আরও কয়েক ক্যাডারকে নিয়ে সেখানে হামলা করে। এদের মধ্যে দীপ ও সাইফুলও ছিল। এ সময় ওই মেস বাড়িতে থাকা ছাত্রদের পাল্টা হামলায় সাদিকুর ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। এ সময় তার কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে আহত হন সাদিকুরের অনুসারী ছাত্রলীগের আজমীর হোসেন ফারাবি আহত হন। ফারাবি পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেনের ছেলে। তবে তাদের লক্ষ্যবস্তু ভুল হওয়ায় গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে রাতেই তারা সেখান থেকে পালিয়ে আসে। এরপর সাদিকুর বাহিনী জমি দখল চেষ্টার ঘটনা চাপা দিয়ে প্রচার দেয় ওই বাড়িতে শিবিরের ক্যাডাররা নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে অভিযোগ তোলে। তাদের প্রতিহত করতে তার বাহিনী এই হামলা চালায়। এঘটনায় ছাত্রশিবিরের কয়েক নেতার নামে অস্ত্র মামলা করা হয়।
প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা অথবা তার অধিক সময় পর্যন্ত তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সাদিকুরের মজমা বসে শহরের কামানগরের প্রাণি সম্পদ অফিসের আশপাশে। বছর খানেক আগে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মৎস্য ব্যবসায়ী আনারুল ইসলামকে ফোনে ডেকে পাঠায় সাদিকুর। প্রাণি সম্পদ অফিসের কাছে নিয়ে সাদিকুর তার কাছে দাবি করে মোটা অংকের চাঁদা। আতংকিত হয়ে আনারুল এক লাখ টাকারও বেশি দিয়ে রক্ষা পান। অবশেষে আওয়ামী লীগের পৌর কমিটিকে অবহিত করে তিনি এ বিষয়ে সাতক্ষীরা থানায় একটি মামলা করেন। এমনকি এ নিয়ে তিনি একটি প্রেস কনফারেন্সও করেন। কিন্তু সে মামলা ভস্মীভূত হয়ে যায় সাদিকুলের মাথার ছাদ সাতক্ষীরার একজন জনপ্রতিনিধির হুংকারের মুখে। সাদিক বাহিনীর সদস্য সাইফুল ইসলাম ২০১৮ এর সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি স্কুলের দপ্তরি মুন্সিপাড়ার সোহাগকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সাইফুল সাদিকুরের লোক এবং সোহাগও সাদিকুরের অনুসারী হওয়ায় এই হত্যার ঘটনাটি বেশিদূর গড়াতে পারেনি। সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে তা চাপা পড়ে যায়।
এক্ষেত্রে তার গাফিলতির অভিযোগ করেছেন সকল পর্যায়ের নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাতটি উপজেলা ও একটি পৌর কমিটি বারবার ভাঙাগড়া করেছেন। টাকার বিনিময়ে কমিটি গঠন করে দেওয়ার পর ২/৩ মাস যেতেই ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে ফের নতুন কমিটি গঠন করেন তিনি। এজন্য নয়া কমিটির কাছ থেকে নতুন করে চাঁদা আদায় করেন তিনি। এসব বিষয়ে ছাত্রলীগের নেতারা সাংবাদিকদের কাছে এমনকি কেন্দ্রেও বারবার অভিযোগ করে আসছেন।
২০১৮ সালের ২৬ মার্চ শহরের আলাউদ্দিন চত্ত্বরে মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যুবলীগের মনোয়ার হোসেন অনুকে ছুরিকাঘাত করে আহত করে সাদিকুরের দেহরক্ষী দীপ। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হলেও সাদিকুরের মাথার ছাদ জনপ্রতিনিধির মন্ত্রে সে অভিযোগও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সাদিকুর মুনজিতপুরের জেলা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ হায়দার আলী তোতার ভাতিজা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তোতার বাড়ি থেকে একদল জুয়াড়ি ও জুয়ার সরঞ্জাম আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এদিকে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সাদিকুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলার দুই আসামি আজিজুল ও শামীমকে পুলিশ জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
নিহত দেহরক্ষী সাইফুল সুলতানপুরে জনৈক আবুবকরের আত্মীয় হিসেবে তার বাড়িতে থাকতো। তা সত্ত্বেও শহরের মুন্সিপাড়ায় ফায়ার সার্ভিসের কাছে একটি ভাড়া বাড়ি রয়েছে সাইফুলের। সেখানে থাকে একাধিক তরুণী। সাইফুল তার বস সাদিকুরকে প্রায়ই নিয়ে যায় সেখানে। সেখানে বেশ আনন্দ ফূর্তিতে সময় কাটে তাদের।
চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, অস্ত্রবণিক থেকে শুরু করে অন্ধকার জগতের হেন শক্তি নেই, যারা ছাত্রলীরের এ নেতা করেনি।
দীপ ও সাইফুলের কথিত গডফাদার সৈয়দ সাদিকুর রহমান তার অন্যান্য সব দেহরক্ষীর হাতে বেআইনি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা এই শহর ও শহরের অদূরে বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগেও ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে শহরে নিয়ে আসা একটি স্বর্ণের চালান অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাদিকুর বাহিনী চোরাচালানিদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। গত ৩০ মে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সাতক্ষীরার সাংবাদিকদের রক্তাক্ত জখম করে দম্ভের সাথে চলে গিয়েছিল। এই হামলাকারীদের মধ্যে ছিল সাদিকুরের বডিগার্ড দীপ ও সাইফুলসহ কয়েকজন। জেলাব্যাপী সকল টেন্ডারের ভাগ বসিয়ে আসছে সাদিকুর বাহিনী।
গত ১৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও সুলতানপুর বড়বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি মো. আমিনুর রহমান সাতক্ষীরা থানায় লিখিত অভিযোগ করেন সাদিকসহ দুই জনের বিরুদ্ধে। তিনি ওই অভিযোগে বলেন, ওই দিন মঙ্গলবার দুপুরে শহরের যমুনা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বড় বাজার যাওয়ার সময় জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারী সাদিক তার মোবাইল থেকে জরুরী কথা বলার নাম করে তাকে পশু হাসপাতালে ডেকে নিয়ে আসে। এসময় সাদিক তাকে বলে আপনি বড়বাজারে ভালো ব্যবসা করেন। অথচ আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখেন না। কোন টাকা পয়সা দেন না। তাই সবাই মিলে আপনার কাছে ৫লাখ টাকা ধার্য্য করেছি। আজকে যা পারেন দেন। বাকিটা কাল সাইফুলের (২নং আসামীর) কাছে দেবেন। এসময় আমিনুর রহমান বলেন, আমি বৈধভাবে ব্যবসা করি এবং নিজেও আওয়ামী লীগের একজন পদধারী ব্যক্তি। সুতরাং কোন চাঁদা দিতে পারবো না। আর এভাবে চাঁদাবাজি করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষতি করবেন না। একথা বলার সাথে সাথে সাদিক ও সাইফুল বাদি আমিনুলের সাথে তুই-তামারি করা শুরু করে এবং কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তাকে মারপিট করে ও শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করে। সাদিক ও সাইফুল ঐদিন আমিনুর রহমানের ব্যাংক থেকে উঠানো দুই লক্ষ টাকা কেড়ে নেয় এবং আরও তিন লাখ টাকা একদিনের মধ্যে দিতে বলে।
তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান জানান, আমি অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় রয়েছি কয়েকদিন। দীপ ও সাইফুলের ঘটনা শুনে মর্মাহত হয়েছি। তারা তো আপনার দেহরক্ষী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেহরক্ষী তো বেতন ভাতা দিয়ে পুষতে হয়। ওরা দেহরক্ষী নয়। ওদের সাথে আমার সম্পর্ক ভাইয়ের মতো। তবে তারা কোনো ঘটনা বিশেষ করে বিকাশ এজেন্টের টাকা ছিনতাইয়ের সাথে তারা জড়িত কিনা এসব বিষয় আমার জানা নেই। সাদিকুর বলেন, তার বিরুদ্ধে আরও যা যা বলা হচ্ছে তা মোটেও সত্য নয়। এ সবই অপপ্রচার ।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।