ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ বেশ কিছুদিন হয়ে গেল বাংলাদেশের ভোটাররা কেন্দ্রবিমুখ। পারতপক্ষে তারা ভোটকেন্দ্রমুখী হন না। অনেকে মজা করে বলেন, দাওয়াত দিয়েও ভোটারদের এখন আর কেন্দ্রে নেয়া যায় না। অবশ্য এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। তীব্র অভিমান মনে জেঁকে বসেছে তাদের। সেই ভোটারদের আশ্বস্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। ভোটারদের প্রতি তিনি কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। নিশ্চয়তা দিয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একই কথা বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব কথায় আশ্বস্ত হয়ে ভোটাররা কি ফের কেন্দ্রমুখী হবেন?
রাজনীতি এমনিতে ভোটমুখী। যদিও তা কতটা ইচ্ছায়, কতটা অনিচ্ছায় সে নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। মাঝে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুতে কড়া কড়া কথা বলে রাজনীতিতে উত্তাপ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন বিএনপির কয়েকজন নেতা। কড়া আন্দোলনের হুঙ্কার দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু খালেদা জিয়ার জামিন হয়নি। তাদের কড়া আন্দোলনের কথাও এখন আর শোনা যায় না। এখন অবশ্য নির্বাচনে মনোযোগী হয়েছেন তারা। চট্টগ্রাম-৮ আসনে উপ-নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বিএনপি প্রার্থী। দলটির হেভিওয়েট নেতারা এরইমধ্যে তারপক্ষে প্রচারণায় নেমেছেন। ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনেও কোমরবেঁধে লড়াইয়ে নামতে প্রস্তুত বিএনপির প্রার্থীরা। এরই মধ্যে তারা দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করে জমাও দিয়েছেন। উত্তরে তাবিথ আউয়াল এবং দক্ষিণে ইশরাক হোসেনেরই বিএনপির প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আজই প্রার্থী হিসেবে তাদের নাম ঘোষণা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে এক ধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। উত্তরে বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামের প্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত। দক্ষিণে সরকার দলীয় এমপি ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মনোনয়নপত্র কেনায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী নিয়ে কৌতূহল তৈরি হয়। একইদিনে কান্না-হাসি দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই হয়েছে মেয়র সাঈদ খোকনের।
সেতো গেল রাজনীতিবিদদের কথা, তাদের প্রার্থী হওয়া, না হওয়ার কথা। কিন্তু আমজনতা, যাদের অনেকের ভোটার তালিকায় নাম আছে, জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তারা কী ভাবছেন। তারা কি ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন? কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাবেন? হরেক রকমের ভোট দেখেছে এদেশের মানুষ। বিস্তর তাদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। হলফ করে বলতে পারি, এতো ধরনের ভোট দুনিয়ার আর কোন দেশের মানুষ দেখেনি। এটাতো সত্য বহু দেশের মানুষ প্রকৃত ভোটও দেখেনি। সে যাকগে। কখনও কখনও এদেশের মানুষ কেন্দ্রে গিয়ে দেখেছেন তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। কখনও আবার তারা ভোট উৎসবে শামিল হয়েছেন। নিজের ইচ্ছায়, পছন্দে ভোট দিয়েছেন। কখনও কখনও তাদের ভয় দেখানো হয়েছে তারা যেন ভোটকেন্দ্রে না যান। আবার কখনও আমন্ত্রিত হয়েও ভোট দিতে পারেননি। নানা অভিজ্ঞতার পর মানুষ খুবই ত্যক্ত-বিরক্ত। বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। একটা সময় ছিল যারা ছিলেন একদিনের বাদশাহ। বছরব্যাপী গণতন্ত্রের অভাব-অনটন থাকলেও ভোটের দিনে তারা রাজা ছিলেন। কিন্তু সেদিনও তাদের আজ আর নেই। যেকারণে স্থানীয় বা জাতীয় যেকোনো নির্বাচনেই অভিমানী ভোটাররা এখন আর কেন্দ্রে যান না। তাদের অভিমান ভাঙাতে বড় কোন উদ্যোগও অবশ্য চোখে পড়ছে না। একটু-আধটু আহ্বান জানানো হয় এই আর কি?
ভোটের ঢাক-ঢোল বাজছে। সরকার আর বিরোধী শিবির, দু’ পক্ষেই রাজনীতিবিদেরা আনন্দিত। ধানমণ্ডি অথবা নয়াপল্টন দু’জায়গাতেই ভিড় বাড়ছে। কিন্তু সাধারণের মধ্যে এ নির্বাচন নিয়ে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো আগ্রহের খবর জানা যায় না। জনপরিসরে তেমন কোনো শোরগোল নেই। কি যেন এক বিতৃষ্ণা তাদের মনে। ভোট নিয়ে যেন কোনো আগ্রহই নেই। আছে উদ্বেগ। নিশ্চিত পরিবেশ পাবেন তো, তাদের ভোট কাউন্ট হবে তো! তাদের ভোট ম্যাটার করবে তো?
বহুমতের ভীতিহীন চর্চার নামই গণতন্ত্র। প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বিউকানান এর বিখ্যাত উক্তি- মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে ভালো মাধ্যম ব্যালট। কিন্তু সে ব্যালটের প্রতি কেন আগ্রহ হারিয়ে ফেললো মানুষ। ক্ষমতাবান মানুষ কেন নিজেই নিজেকে ক্ষমতাহীন ঘোষণা করলো। তা কি মানুষের এক ধরনের নীরব প্রতিবাদ। এ প্রশ্নের জবাব রাজনীতিবিদদেরই খোঁজার কথা। যদিও এ উত্তর খুঁজলে সবসময় তাদের লাভ হয় না। কে বলে ব্যালটের প্রাণ নেই? কারা জিতলো, কারা হারলো তাতে হয়তো বা ব্যালটের কিছু আসে-যায় না। যেমন আসে-যায় না সংখ্যাগরিষ্ঠ সংগ্রামী মানুষের। কিন্তু নির্বিঘ্ন ভোট উৎসবেই ব্যালট তার ক্ষমতা খুঁজে পায়। ভোট উৎসব ফিরবে তো? সংশয়! সংশয়ই এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।