বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে পর্যটকদের অকৃষ্ট করতে নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে নেওয়া হয়েছে সাতটি ইকোপার্ক মেরামত ও সংস্কারসহ নতুন চারটি ইকোপার্ক স্থাপন প্রকল্প। পর্যটকদের দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ থেকে সুরক্ষা দিতে দ্রুতগতির নৌযান কেনার পরিকল্পনাও রয়েছে। ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এসব প্রকল্প প্রাথমিক অনুমোদনও পেয়েছে। এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সুন্দরবনে ঘুরতে আসেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে দীর্ঘদিনেও পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। পর্যটকদের জন্য প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। বনের মধ্যে থাকা ওয়াচ টাওয়ার, জেটিগুলোও নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান জানান, “সুন্দরবনে প্রতি মৌসুমেই সাধারণত দেড় থেকে দুই লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। এ থেকে দুই কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় হয়। সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য এখন সাতটি ইকোপার্ক রয়েছে। এ অবস্থায় ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটক সুবিধা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’-এর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা অনুমোদিত হলে আগামী জুলাই থেকেই বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। প্রকল্প ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো সাতটি ইকোপার্কের উন্নয়ন, নতুন আরও চারটি ইকোপার্ক স্থাপন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণসহ সার্বিক উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমরা শিগগিরই অনুমোদন পাওয়ার আশা করছি।”
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছরই সুন্দরবনে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন এক লাখ ৮১৭ জন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক লাখ ২৮ হাজার ১৭৫ জন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক লাখ ৮৩ হাজার ৪৯০ জন পর্যটক, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভ্রমণ করেন দুই লাখ ২১ হাজার ৯৬৯ জন পর্যটক। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন দুই লাখ ৫১ হাজার ৯৬৯ জন পর্যটক। গত বছর পর্যটন খাত থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় হয় দুই কোটি টাকা।
সুন্দরবন ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখনও বেশ কিছু সমস্যায় পড়ছেন তারা। বনের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। ফলে সুন্দরবনে প্রবেশের পর পর্যটকদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে হয়। প্রয়োজনীয় জরুরি চিকিৎসা সেবার কোনও ব্যবস্থা নেই। সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।
ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা জামালউদ্দিন বলেন, ‘দেশের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে সুন্দরবন। যাকে ঘিরে মানুষের রয়েছে অনেক আগ্রহ। সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগেই মানুষ এখানে আসছে ঘুরতে। পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। তবে এখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকারি উদ্যোগ কম। আগে মানুষ বন ও জলদস্যুদের ভয়ে তটস্থ থাকতো। বর্তমানে মনে হয়েছে অনেক নিরাপদ এলাকা। এরপরও সুন্দরবনের কটকা ও কচিখালিসহ সাগর ও নদীর মোহনায় যেসব স্পটে পর্যটকদের নিয়ে জাহাজগুলো নোঙর করে, সেসব স্থানে আরও নিরাপত্তা বাড়ানো উচিত। এসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। জাহাজের সারেংরা নিজস্ব রেডিও চ্যানেলে একজন আরেকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সেই চ্যানেলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। কিন্তু পর্যটকদের ওপর হামলা হলে তা ঠেকানোর কোনও সুযোগ আছে বলে মনে হয়নি। কারণ, নিরপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর অনেক আগেই দুর্বৃত্তরা নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হবে।’
ট্রাভেল এজেন্সি এভারগ্রিন ট্যুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজহারুল ইসলাম কচি জানান, ‘সুন্দরবনে পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নাজুক। প্রতিটি লঞ্চে মাত্র দুই জন করে বনরক্ষী দেওয়া হয়। বনরক্ষীরা বয়স্ক ও তাদের অস্ত্র চালানোর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। সুন্দরবনের মধ্যে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট। পর্যটকদের আবাসনের কোনও ব্যবস্থা নেই। তাদের লঞ্চ বা বোটের মধ্যে রাত কাটাতে হয়। কাঠের তৈরি ওয়াচ টাওয়ারগুলো নড়বড়ে। পর্যটকদের বহনকারী লঞ্চ বেঁধে রাখার মতো ভালো ব্যবস্থা নেই। বন বিভাগের জেটিতে লঞ্চ বাঁধতে দেয় না। ফলে মাঝ নদীতে নোঙর করে রাখতে হয়।’
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন বলেন, ‘সুন্দরবনে পর্যটকদের সেবা সহায়তা সহজ করতে পদক্ষেপের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পর্যটকরা যাতে কোনও বিড়ম্বনায় না পড়েন তা মনিটরিং করা হচ্ছে। পর্যটকদের জন্য সুনির্দিষ্ট ঘাটের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে। আর পর্যটকদের জন্য থাকা ট্যুর গাইডদের সার্বিকভাবে সতর্ক থাকার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য জনবলকে প্রধান্য দেওয়া হচ্ছে। এখানে এক-তৃতীয়াংশ জনবল ঘাটতি রয়েছে। তারপরও ইকোপার্ক এলাকায় প্রয়োজনীয় জনবল রাখা হয়। কারণ, সেখানে জনবল কম থাকলে পর্যটকরা সঠিক ও প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন।’
সুন্দরবনের পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, পর্যটকদের সে ব্যাপারে আরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন উল্লেখ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সুন্দরবনে আসা পর্যটকদের কিছু ভুল করতে দেখা যায়। তারা বন্যপ্রাণিকে খাবার দেন, উচ্চশব্দে কাজ করেন। যা বনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সচেতনতার অভাবে পর্যটকরা নদী ও সুন্দরবন এলাকায় পলিথিন, প্যাকেট, খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে থাকেন, যা পরিবেশকে বিষিয়ে তোলে। আইন প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা কঠিন। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। যার সফলতা নির্ভর করছে ট্যুর গাইডদের সতর্কতার ওপর। কোনও স্পটে একত্রে কতজন পর্যটক যেতে পারবেন তা নির্ধারণে কাজ চলছে। সুষ্ঠু পর্যটন সেবা প্রদানে জলযান ট্র্যাকিং করতে সিস্টেমে আনা হচ্ছে। পর্যটকদের গতিপথও ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার্থে অনলাইনে সুন্দরবন ভ্রমণের অনুমতি প্রদানের চিন্তা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নতুন প্রকল্পের আওতায় নতুনভাবে চারটি ইকোপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। যার দুটি হবে পশ্চিম সুন্দরবনের আওতায়। এগেুলো হচ্ছে কালাবগি ও শেখেরটেক। পর্যটকদের দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ থেকে সুরক্ষা দিতে দ্রুতগতির নৌযান কেনার পরিকল্পনা রয়েছে। নৌযান কেনা হলে পর্যটকদের জরুরি সেবা দেওয়া সহজ হবে।’
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বনের তেমন ক্ষতি না হলেও অফিস ও ইকোপার্ক এলাকায় কিছু ক্ষয়ক্ষতি ছিল, যা নিজস্বভাবে অনুন্নয়ন খাত থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে সংস্কার ও মেরামত করার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আরও বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে পর্যটকরা আরও সুবিধা পাবেন।’
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার এমপি বললেন, ‘৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কাজের অনুমোদন মন্ত্রণালয়ই দিতে পারে, একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) যেতে হয় না। সেই হিসেবে বন বিভাগের প্রকল্প প্রস্তাব পাস হয়ে যাবে। কয়েকটা স্টেপ বাকি আছে। জুলাইয়ের আগেও কাজ শুরু হতে পারে।’
তিনি জানান, ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প শুরু হয় ২০১১। কিন্তু এটার আওতায় আসলে সুরক্ষার কোনও কাজ হয়নি। ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটক সুবিধা উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প’-এর মাধ্যমে সুরক্ষার কিছু কাজ করা হবে। প্রাথমিক অনুমোদন হয়ে গেছে। তবে কিছু ত্রুটি আছে। ত্রুটির মধ্যে রয়েছে, গাছের উচ্চতা অনুযায়ী সুন্দরবনে ৭০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ ফুট করে দেওয়া হয়েছে। সমস্যা হলো, সুন্দরবনে সর্বোচ্চ গাছের উচ্চতা ৬৫-৭০ ফুট। কাজেই ৭০ ফুটের নিচে ওয়াচ টাওয়ার করে কোনও সুফল পাওয়া যাবে না। আমরা আবারও এটা বাড়িয়ে আনার চেষ্টা করছি। এছাড়া সুন্দরবনে যে ৬৪টি টহল ফাঁড়ি আছে, এগুলোর সবই বাঁশ ও চাটাইয়ের। বনরক্ষীরা এগুলোতে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। এগুলো অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকি হ্রাসেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে