ক্রাইমবার্তা ডেস্করিপোটঃ নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের পিস প্যালেসের প্রতিই এখন সবার দৃষ্টি। কী আছে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে, এটা জানতে উদগ্রীব বিশ্ববাসী। রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যার অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে পারেন ‘ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস’ (আইসিজে)। আজ পিস প্যালেসে হেগের সময় সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪টা) আদালত প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী আদেশ দেবেন। এর আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা ওই মামলার শুনানি হয় গত বছরের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর। তারপর ১৭ বিচারক গোপন বৈঠক করেছেন।
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজ সরাসরি এ আদেশ শুনতে পাবেন। বিশেষ করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আদেশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। গাম্বিয়া আর্জিতে ৬টি অন্তর্বর্তী আদেশের জন্য আবেদন করেছিল। মিয়ানমার বলছে, আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হতে পারে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা আমলে না নেয়ার কথা ভাবাই যায় না। তবে গাম্বিয়ার আর্জির ছয়টি পদক্ষেপের সবগুলোর বিষয়ে আদালতের আদেশ দেয়ার সম্ভাবনা কম। গণহত্যা বন্ধসহ রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় জরুরি যেসব পদক্ষেপ চাওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে আদেশ আসতে পারে।
আইসিজের এ ঐতিহাসিক আদেশের প্রতি ঢাকার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। এ আদেশের ওপর নির্ভর করে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ঢাকার ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণ করা হবে বলে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। ওই ঘটনাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া।
যদিও গণহত্যার কথা অস্বীকার করেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। শুনানিতে তিনি বলেন, সেখানে যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত হয়েছে তা অভ্যন্তরীণ। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের কোনো প্রয়োজন নেই বলে সু চি অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন সু চি। রোহিঙ্গা বিষয়ে অন্তর্বর্তী রায়ের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সফর করছেন রোহিঙ্গা সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিসের পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদ বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় ইতিবাচক আদেশ আশা করি। তবে রায়ের আগে কিছুই বলা যায় না।’ গণহত্যার মূল অভিযোগগুলো বিশদ তদন্তের আগে জরুরিভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন করেছিল মামলার বাদী গাম্বিয়া।
পাশাপাশি, রাখাইনে সংঘাত যাতে আরও তীব্র না হয় সেই লক্ষ্যেও মামলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অন্তর্বর্তী আদেশ চাওয়া হয়। গাম্বিয়া আদেশে অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধ করাসহ ছয়টি জরুরি আদেশ দেয়ার আবেদন করেছে। গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় বলেছে, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা গণহত্যা মামলায় গাম্বিয়ার অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদনের ব্যাপারে আইসিজে বৃহস্পতিবার ২৩ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত জানাবেন।’
আইসিজের রায়ের আগে মিয়ানমার নিজেরা তদন্ত করেছে বলে দাবি করেছে। এতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধ হলেও তাকে গণহত্যা বলা যায় না। বিষয়টা সম্পূর্ণই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারযোগ্য নয়। শুনানিকালে তাই অং সান সু চি মামলাটি খারিজ করার জন্য আদালতের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের গঠিত ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ তদন্ত করে গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গণহত্যার প্রমাণ পেয়েছে।
সু চির বক্তব্য খণ্ডন করে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনে কাজ করা ব্রিটিশ আইনজীবী এন্টনিয়া মালভে বলেছেন, ‘গাম্বিয়া খুবই শক্তিশালী মামলা করেছে। এ মামলা আইসিজের আমলে নেয়ার এখতিয়ার নেই- এমন কথা কল্পনাও করা যায় না।’ মারভে মানবাধিকার সংস্থা লিগ্যাল অ্যাকশন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের পরিচালক। তিনি মনে করেন, আদালত সম্ভবত ছয়টি পদক্ষেপের সবগুলো গ্রহণ নাও করতে পারেন যার মধ্যে স্বাধীন তদন্ত দল গঠনের আর্জিও করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তবে আমরা আশা করব, আদালত এমন সব পদক্ষেপ নেবেন যাতে অন্তত গণহত্যার ঘটনা যেমন হত্যা, যৌন সহিংসতার ঘটনা আর না ঘটে। মিয়ানমার এসব ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকে। আমরা আরও আশা করব, আদালত অন্তর্বর্তী ছয় পদক্ষেপের মধ্যে তৃতীয় অর্থাৎ মিয়ানমার প্রমাণ ধ্বংস করা থেকে যেন বিরত থাকে সে ব্যাপারে আদেশ প্রদান করেন।’
আইসিজে ইতিপূর্বে গণহত্যা কনভেনশন ১৯৯৩ আলোকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়ার অনুরোধে ইগোশ্লোভিয়ার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে একই ধরনের অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছিলেন। দুই বছর পর প্রমাণ হয় যে, সেখানে গণহত্যা হয়েছে। বসনিয়ার আট হাজার পুরুষ ও কম বয়সী ছেলেদের হত্যা করা হয়।
মালভে বলেন, ‘প্রতি ৪ মাস পরপর অন্তর্বর্তী আদেশের বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে সে ব্যাপারে আদালতে প্রতিবেদন দেয়ার জন্যে মিয়ানমারের প্রতি আদেশ দিতে আর্জিতে উল্লেখ করেছে গাম্বিয়া’। অন্তর্বর্তী আদেশ মামলার মেরিটের কোনো প্রতিফলন না হলেও তিনি বলেন, ‘এটা একটা ব্যতিক্রমী তাৎপর্যপূর্ণ প্রাপ্তি। রোহিঙ্গারা এখনও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক আদালত বিষয়টা বিবেচনায় নিয়েছে যা রোহিঙ্গাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠালগ্নে যে ছয়টি প্রধান অঙ্গ নিয়ে গঠিত হয়েছিল তার অন্যতম আইসিজে। দুই দেশের মধ্যে বিরোধ নিস্পত্তির লক্ষ্যে এ আদালত রায় দিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত দেড়শ’টি মামলার রায় দিয়েছেন আইসিজে। অধিকাংশ রায় কার্যকর হয়েছে।
তবে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারে জাতিসংঘের আরেকটি আদালত রয়েছে। তার নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট’ (আইসিসি)। মিয়ানমার আইসিসি গঠনের রোম সংবিধিতে সই করেনি। তবে বাংলাদেশ এতে সই করেছে। ভবিষ্যতে আইসিসিতে মামলাটি করা হতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।