ঘণ্টা বাজছে তুমুল। দিন তিনেক বাদেই ভোট। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। বলেছেন, সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল। যদিও এরই মধ্যে প্রার্থী আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। রক্তাক্ত রাজনৈতিক কর্মী, সংবাদকর্মীর ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এই যখন অবস্থা তখন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের একটি বক্তব্যে বিপুল কৌতূহল তৈরি করেছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, খোদ নির্বাচন কমিশনে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।
তার বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর। সচিবের বক্তব্যে কোনো কোনো সংবিধান বিশেষজ্ঞ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সচিব কী করে একজন সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির সমালোচনা করেন তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। যদিও এরচেয়ে বেশি বিস্ময় তৈরি করেছে সিটি নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তায়। দুই সিটির নির্বাচন নিয়ে এরইমধ্যে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর কমিশনের তিনটি বৈঠক হয়েছে। এর কোনোটিতে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের আচরণবিধি, অনিয়ম বা প্রার্থীদের অভিযোগ সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয়নি এবং কোনো কমিশন সভায় এসব বিষয় এজেন্ডাভুক্ত হয়নি। আজও ইসির যে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে, তাতেও ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কিত কোনো বিষয় এজেন্ডাভুক্ত নয়। এটা কী করে সম্ভব তা বুঝে আসছে না সাবেক নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেনের। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৫০ লাখের অধিক ভোটার। ১৫ জন সংসদ সদস্য। এই সময় ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছাড়া নির্বাচন কমিশনে আর কোন আলোচনার বিষয় আছে বলে আমি জানি না।
যখন নির্বাচন হয় তখন ওই নির্বাচনের অগ্রগতি নিয়েই আলোচনা হয়। এতগুলো কথা চলছে, আচারণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে, মারপিট হচ্ছে, ফ্রি স্টাইল পোস্টার ছাপানো হচ্ছে, ফ্রি স্টাইল ব্যানার লাগছে এরপরেও যদি আলোচনা না হয় তাহলে আমি জানি না নির্বাচন কমিশন এখন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে। রোববার নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে ইসির অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে গুরুতর অভিযোগ করেন মাহবুব তালুকদার। তিনি অভিযোগ করেন, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে যে সব পর্যবেক্ষণ, সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়েছেন তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। এমনকি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকগুলোতে এসব বিষয় এজন্ডাভুক্তও করা হয়নি। মাহবুব তালুকদারের এ বক্তব্য প্রকাশের কিছু সময় পর নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, একজন কমিশনার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তথ্য চাইলে তিনি দিতে বাধ্য নন। কোনো কমিশনারের বক্তব্যের বিষয়ে সচিবের এ প্রতিক্রিয়াকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। গতকাল আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, ঘরের বিষয় বাইরে আনা মাহবুব তালুকদারের উচিত হয়নি। তিনি অনেকটা বিএনপির সুরে কথা বলছেন। যদিও এর আগে মাহবুব তালুকদারের এমন ভিন্নমত প্রকাশকে স্বাগত জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।
পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এলেও ঢাকার নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদার যে অভিযোগ করেছেন তা খুবই গুরুতর বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অভিযোগের বিষয়ে জবাব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে আসা উচিত ছিল। বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। তা না করে ইসি সচিব জবাব দিয়ে নির্বাচন কমিশনের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতাকেই প্রকাশ করেছেন। এর আগে মাহবুব তালুকদার কয়েকটি আনঅফিসিয়াল নোটে মন্ত্রী এমপিদের প্রচারণায় অংশ না নেয়ার পরিপত্র জারি ও নির্বাহী হাকিমদের কার্যক্রম দৃশ্যমান করার তাগিদ দেন। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে এ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে, বিশিষ্ট আইনজীবি ড. শাহদীন মালিক বলেন, এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচন কমিশনে প্রচণ্ড সমন্বয়হীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, নিকট অতীতে অন্যান্য ঘটনায় এ সমন্বয়হীতা একাধিক কমিশনার ব্যক্ত করেছেন এটি নিঃসন্দেহে নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার কাজ ব্যহত হচ্ছে। আর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে আচরণবিধি যত্রতত্র যে লঙ্ঘন হচ্ছে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের প্রায় সর্ম্পূণ নিষ্ক্রিয়তা সুষ্ঠু সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ব্যাপারে আমাদেরকে উদ্বিগ্ন না করে পারছেনা। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত অতীতের নির্বাচনের মত এটাও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা এই প্রশ্নটা এখন বড় করে দেখা দিয়েছে। এছাড়াও এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আদৌ সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভবত সম্ভব হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সচিব হচ্ছেন নির্বাচন কমিশনারের অধীনস্ত কর্মকর্তা। তিনি কোনভাবেই কমিশনারের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেননা। সরকার চেষ্টা করছে ভিন্ন মতকে দমন করবার। তারই অংশ হিসেবে হিসেবে সচিব এসব কথা বলছেন। এমন কথা বলায় সরকারি আচরণ বিধি লঙ্ঘন হয়েছে কীনা তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বলেন, নির্বাচন কমিশনারের অধীনে কাজ করেন সচিব। কোনভাবেই তিনি পাল্টা বক্তব্য দিতে পারেন না। বিষয়টি অনাকাঙ্খিত ও অশোভনীয়। তারা এসব কাজকর্ম করে আমাদের একটি ভয়ানক ভাবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির অবশ্য কমিশনার মাহবুব তালুকদারের উন্মুক্ত মত প্রকাশের বিপক্ষে। এ বিষয়ে তিনি বলেন নির্বাচন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সকলে মিলে একত্রিত হয়ে গঠনমূলক যোগসূত্র যাকে বলে তা করতে হবে। যে ব্যক্তিগত মতামত দিয়েছেন মাহবুব তালুকদার সাহেব এটা উনার বলাটা ঠিক হয়নি । উনি যদি মনে করেন নির্বাচন কমিশনে উনি যতটুকু সহায়তা পাওয়া উচিৎ সেটা উনি পাচ্ছেনা না। তাহলে উনার পদত্যাগ করা উচিৎ। তিনি আগের নির্বাচনেও এ ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। তিনি পদও ধরে থাকবেন আবার কথাও বলবেন এটা ঠিক নয়। তার পদত্যাগ করার উচিৎ।
ইসিতে দু’দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে
আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরস্পর বিরোধী অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রতিনিধিদল। তবে ভোটের পরিবেশ লেভেল প্লেইং আছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। গতকাল বিকেলে আগাঁরগায়ে নির্বাচন কমিশনে প্রথমে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নেতৃত্বে আসেন বিএনপির ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এরপর বিকাল সাড়ে চারটায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনার কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আসেন ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। তারা পৃথক ভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, কবিতা খানম ও সিনিয়র সচিব আলমগীর হোসেন। বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইলেক্ট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংখ্যা দেবে এবং ভোটের দিন সন্ধ্যার সময় পর্যবেক্ষকরা বলবে ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ২২টি নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা রয়েছে এর মধ্যে ১৮টির কোনো ওয়েবসাইট নাই। এদের অধিকাংশকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের লোকবলও নাই। যে দুই একটি পর্যবেক্ষক সংস্থার ওয়েবসাইট আছে তা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের। তারা সন্ধ্যার সময় বলবে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অথচ ব্রতি, ফেমার মত সংস্থার নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত পোস্টারের চেয়ে বড় পোস্টার দিয়ে ঢাকা শহর ছেয়ে ফেলেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। আইনকানুন ভঙ্গ করে নির্বাচন করার যে সংস্কৃতি, এটা কী হঠাৎ করে নির্বাচনের দিন পরিবর্তন হয়ে যাবে? এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে? মাঠে ম্যাজিস্ট্রেটদের কোনো ভ্রাম্যমান দল নেই বলেও অভিযোগ করেন খসরু। তিনি বলেন, ‘বিএনপির প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে। তাদের ওপর কোনো নিরাপত্তা নাই। আমরা প্রথম দিন থেকে বলছি, তাদেরকে নিরাপত্তা দেন। প্রার্থীর গায়ে হাত তুলছে, তাতেও মামলা হচ্ছে না।
‘রাজধানীর গোপীবাগে দক্ষিণ সিটির বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেন ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে মারামারি ঘটনা ঘটে।’ এই প্রসঙ্গ বৈঠক শেষে এইচ টি ইমাম বলেন, গতকালের পুরো ঘটনাটি সাজানো, পূর্ব পরিকল্পিত এবং এমনভাবে করেছে বিএনপির ক্যাডাররা। আমাদের কাছে তথ্য আছে, ২০১৪ থেকে ২০১৫ সালে বিএনপির সন্ত্রাসীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাস করেছিল। পরবর্তীকালে যারা ছাড়া পেয়েছে। তাদের অনেককেই ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে, দলগতভাবে তারা ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। সুযোগ মত তারা পরিস্থিতি এমন সৃষ্টি করতে পারেন, যাতে নির্বাচনটি বানচাল হয়ে যায়। তিনি বলেন, এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বোধহয় রাখছেন জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা। তাদেরকেই আনা হচ্ছে। গতকাল যে আক্রমণ করা হয়েছে, যে অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর তথ্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছি। আমাদের অনেকেই আহত হয়েছেন। যাদের শরীরে গুলির আঘাত আছে, তারা হাসপাতালেও আছেন। সেসব প্রমাণও আমাদের কাছে আছে। সরকারি দলে যখন আছি, আমরা তো চাইব, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য হোক।https://www.mzamin.com/