ক্রাইমবাতা রিপোটঃ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে নির্বাচনী অপরাধের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। বাড়ছে সহিংসতার শঙ্কাও।
বুধবার সন্ধ্যায় নির্বাচনের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে আকস্মিক বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনাররা।
ওই বৈঠকে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। নির্বাচনের বিদ্যমান উৎসবমুখর পরিবেশ-পরিস্থিতি বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
হঠাৎ গণহারে ধরপাকড়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হয়রানি বা অন্য কোনো অ্যাকশনের মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়- সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
এছাড়া ভোটে নাশকতার শঙ্কায় বহিরাগতদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক রয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়েছে।
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় শেষ হচ্ছে দুই সিটির প্রচার। এদিন মাঠে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র আরও জানিয়েছে, দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে সহিংসতা, প্রচারে বাধা দেয়া, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়াসহ নানা গুরুতর অভিযোগ করছেন প্রার্থীরা।
গত দু’দিনে এ ধরনের প্রায় ৩০টির মতো অভিযোগ জমা পড়েছে। বুধবার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে অন্তত ১০৭টি ও উত্তর সিটিতে ৬০টি অভিযোগ জমা পড়েছে।
এর বেশিরভাগ অভিযোগই আমলে নিয়েছে দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর। ওই সব ঘটনা তদন্ত ও দায়ীদের সতর্ক করে দেয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করেছে। কারও বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি ইসি।
এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ১ হাজার ৩১৮টির ৮৭৬টি ও দক্ষিণ সিটিতে ১১৫০টির মধ্যে ৭২১টি ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নির্বাচনী অভিযোগে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রার্থিতা বাতিল করতে বসিনি, নির্বাচন করতে বসেছি।
যারা অভিযোগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে রিটার্নিং কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জানতে র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশ কমিশনারকে ডেকে আনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তাদেরকে একটাই ম্যাসেজ দেয়া হয়েছে ভোট যেন আইনানুগ ও গ্রহণযোগ্য হয়- সেই পরিবেশ বজায় রাখা হয়।
নির্বাচনের পরিস্থিতির অবনতি যাতে না হয়, সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকজন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি।
তাদেরকে বলেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে যেন হয়রানি ও গণহারে গ্রেফতার না করা হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। বহিরাগতরা যেন অকারণে কেন্দ্রে না আসেন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর বলেন, সার্বিক বিষয় বিবেচনায় ভোটের দিন যেন যারা ভোটার নয়, যারা বহিরাগত তারা যেন ভোটকেন্দ্রে না আসেন- সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এমনকি যদি অত্যন্ত প্রয়োজন না থাকে অর্থাৎ নিষ্প্রয়োজনে কেউ যেন ঢাকায় অবস্থান না করেন। যাদের জরুরি প্রয়োজন, তাদের তো থাকতেই হবে। তাদের যেন পুলিশ এলাউ করে।
যদি কোনোই কারণ না দেখাতে পারে, শুধু শুধু ঢাকায় এসেছে, তাদের চলে যেতে বলা হয়েছে। ইসির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, ২০১৫ সালের অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের তুলনায় এবার সহিংসতা অনেক কম হয়েছে।
বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা প্রচারে সমান সুুযোগ পেয়েছেন। সবদিক বিবেচনায় নির্বাচনের পরিবেশ এখনও শান্তিপূর্ণ আছে বলে মনে করছে কমিশন।
তবুও যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো আইনগতভাবে তদন্ত বা সতর্ক করে দেয়ার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতেই এভাবেই নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
তারা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখন পর্যন্ত পরিবেশ ভালো থাকলেও দুই দলের বিপুলসংখ্যক বহিরাগত ঢাকায় অবস্থান করছেন। ভোটের দিন এসব বহিরাগতদের ভূমিকা কী হতে পারে- তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কায় রয়েছে কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এক কর্মকর্তা বলেন, অনেকটা আকস্মিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনাররা।
ওই বৈঠকে গণহারে ধরপাকড় বা ক্রাকডাউনের মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সবার জন্য সমান সুযোগ যেন অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশংসা করা হয়।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত দুই সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরে ১৬৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সোম ও মঙ্গলবার এ দু’দিনে জমা পড়েছে প্রায় ৩০টির মতো অভিযোগ।
এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ৬০টি ও দক্ষিণ সিটিতে ১০৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে সেগুলোর সিংহভাগই কাউন্সিলর প্রার্থীরা করেছেন।
এসব অভিযোগে সহিংসতা ও মারধরের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী ফারহান আহম্মেদ বৈশাখী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তার কয়েক কর্মীকে মারধর করা হয়েছে।
আরও কয়েক কর্মীকে পথরোধ করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. নাঈম তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেছেন।
৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের কেএম ফজলুল হক তার কর্মী-সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
এছাড়া ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেহেরুন নেছা ও মনিরুজ্জামান মানিক, ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের মো. খোরশেদ আলম, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের মকবুল ইসলাম খান টিপুসহ মোট ১২০ জন বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা অনেক অভিযোগ পাচ্ছি। সেগুলো আইনানুগভাবে নিষ্পত্তি করছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর হওয়া দরকার। চলতি সপ্তাহে ঢাকা উত্তর সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জুয়েল রানা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচারে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেন।
প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের হুমায়ুন কবির আহমেদ, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আহসান উল্লাহ চৌধুরী হাসান, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সালাহউদ্দিন রবিন, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের মো. জাইদুল হোসেন মোল্লাসহ কয়েকজন প্রার্থী। ওই ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সতর্ক করা হয়েছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ওসির মাধ্যমে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে সতর্ক করা হয়। এছাড়া কয়েকজন প্রার্থী সহিংসতা ও মারধরের অভিযোগ করেছেন।
কয়েকটি ঘটনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একইভাবে আরও কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম বলেন, আমরা অভিযোগগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করছি।
অনেক প্রার্থীকে আমি নিজে ডেকে সতর্ক করেছি। তবে কারও প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে স্বীকার করেন তিনি।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র : দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর সূত্রে জানা গেছে, দুই সিটি নির্বাচনের ঝুঁকিপূর্ণ ও সাধারণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোট ১ হাজার ৩১৮টির ৮৭৬টি ও দক্ষিণ সিটিতে ১১৫০টির মধ্যে ৭২১টি ঝুঁকিপূর্ণ (গুরুত্বপূর্ণ) কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৮ জন মোতায়েন করা হবে। আর সাধারণ কেন্দ্রে মোতায়েন করা হবে ১৬ জন সদস্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা উত্তরে ২৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে কেন্দ্রে এবং ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠানে একাধিক কেন্দ্র রয়েছে। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৩৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে ও ৩১৩টি প্রতিষ্ঠানে একাধিক কেন্দ্র রয়েছে।
মাঠে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে আজ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে প্রচার শেষ হচ্ছে। এদিন সকাল থেকে মাঠেন নামবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭ প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের ৫৪টি টিম এবং পুলিশ ও এপিবিএনের সমন্বয়ে ৫৪টি মোবাইল ফোর্স, ১৮টি স্ট্রাইকিং ও ২৭টি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে নামছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৩৮ প্লাটুন বিজিবি, ৭৬টি র্যাবের টিম, পুলিশ ও এপিবিএন সমন্বয়ে ৭৫টি মোবাইল ও ২৫টি স্ট্রাইকিং ফোর্স মাঠে নামছে।
এ সিটিতে পুলিশের ২৫টি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে মোটরসাইকেল চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ হচ্ছে।jugantor.com