ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ সাতক্ষীরা: সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে স্বামী প্রাণ হারানোর পর থেকে ‘অপয়া’ পরিচিতি নিয়ে বেঁচে আছেন মোসাম্মৎ রশিদা। তাকে ছেড়ে চলে গেছে তার সন্তানরা। সব সময় শুনতে হয় প্রতিবেশীদের ভর্ৎসনা। গ্রামে আখ্যা পেয়েছেন ডাইনি হিসেবে। কিন্তু তার একমাত্র অপরাধ হচ্ছে, বাঘের হাতে স্বামীর মৃত্যু। এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, রশিদার মতো এমন অনেক নারী রয়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে। তাদের স্বামী সুন্দরবনে বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে বাঘের থাবার শিকার হয়েছেন।
আর পরবর্তীতে এই দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করা হয়েছে তাদের স্ত্রীদের। স্থানীয়ভাবে তারা বাঘ বিধবা নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর এক প্রান্তে গাবুরা গ্রাম যেখানে থাকেন রশিদা। এটি মৌয়ালদের গ্রাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিশেষজ্ঞ মনিরুল খান জানিয়েছেন, মধু সংগ্রহকারীরা মূলত সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মধু আহরণ করে। বনের এই অঞ্চলেই মানুষখেকো বাঘ বেশি থাকে। বাঘ একটি বিপন্নপ্রায় প্রাণী। বাংলাদেশে মাত্র শ’খানেক বাঘ রয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা প্রায়ই খাবারের খোঁজে বাধ্য হয় গ্রামগুলোতে হামলা করতে। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে ৫০টি গ্রামে অন্তত ৫১৯ জন বাঘের শিকারে পরিণত হয়েছেন।
রশিদা বলেন, আমার স্বামী সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের হাতে মারা গেছেন। এরপর থেকে আমার ছেলেরাও আমাকে ডাইনি ও অপয়া ডাকছে। তারমতো স্বামীহারা বাকিদের অবস্থাও একইরকম। এমনিতেই তারা তাদের স্বামীকে হারিয়ে অথৈ জলে পড়েছেন। তার ওপর তাদের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয় অপয়া ডাক। যখন নিজের স্বজন ও গ্রামবাসীদের থেকে তাদের সব থেকে বেশি সমর্থন দরকার তখন তারাই তাকে দূরে সরিয়ে দেয় অপবাদ দিয়ে। তাদেরকে একরকম খালি হাতেই নিজের বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়।
এ নিয়ে কষ্ট পেলেও বিস্মিত নন রশিদা। তিনি বলেন, আমার ২৪ ও ২৭ বছরের দুই ছেলে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু এতে আমি অবাক হইনি। কারণ তারা তো এই সমাজেরই অংশ। রশিদার বাড়িতে কোনো ছাউনি নেই। তার ছাদ সাইক্লোনে উড়ে গেছে। কিন্তু স্থানীয় কর্মকর্তা ও প্রতিবেশীরা তাকে কোনো সাহায্য করেনি। গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত সকল বাড়িই মেরামত হয়েছে। শুধু তারটিই হয়নি। সেখানে তিনি একটি পুরনো ত্রিপল ব্যবহার করছেন। যদিও স্থানীয় কর্মকর্তারা রশিদার বাড়ি ঠিক করে দিতে সাহায্য না করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তার পাশের বাড়িটি মোহাম্মদ হোসাইনের। তিনি নিজের বাড়ির ছাদ ঠিক করছিলেন। তাকে তার স্ত্রী রশিদার সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছে। তিনি জানান, যদি আমি রশিদার সঙ্গে কথা বলি তাহলে তা আমার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে।
এমন আরেক বাঘ বিধবা সোনামণি। তিনি বললেন, বাড়ি নাই, ঘর নাই, কাজ নেই, অর্থকড়ি নেই। ছেলেপুলে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবো, কী খাবো? কষ্টের শেষ নাই। নাম তো অনেকবার লিখলো। কিছুই তো পাইলাম না। সমাজের কাছেও বোঝা হয়ে আছি। স্বামীকে বাঘে নিয়েছে বলে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। মিশতে চায় না। পাশে দাঁড়ায় না। তার দুই স্বামীকে বাঘে নেয়ার কারণে এই নামটি এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। সুন্দরবনের ধানখালী গ্রামে তার বাড়ি। স্বামীকে বাঘে নেয়ার দায় নিয়ে কষ্টে জীবন চলছে তার।
সোনামণির প্রথম স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর মাত্র একমাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শাশুড়ি। শিশুটিকে নিয়ে পথে নামতে হয় তাকে। পরে সোনামণির বিয়ে হয় তার দেবরের সঙ্গে। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে তাকেও বাঘে ধরে নিয়ে যায়। দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর সোনামণি ‘স্বামীখেকো’ বলে পরিচিতি পায়। সমাজ তাকে দেখে ভিন্ন চোখে। সমাজে চলাফেরাই তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। শাশুড়ি তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে সোনামণির মুখ দেখতে না হয়।
এ নিয়ে লেডারস বাংলাদেশের প্রধান মোহন কুমার মন্ডন বলেন, এই ধরনের প্রথা মূলত অধিক রক্ষণশীল গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দেখা যায়। তারা শতাব্দী পুরনো কুসংস্কার ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। এখানে প্রধান সমস্যা হলো মানুষের বিশ্বাস পরিবর্তন করা। কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসছে। তবে তা খুবই ধীর। তরুণরা সাধারণত কথিত এই ধারণায় বিশ্বাস করে না।
মধু সংগ্রহের কাজ সহজেই করা যায় বলে যাদের পুঁজি নেই তারাই এ পেশায় আসেন। তবে এতে রয়েছে মাছ ধরা কিংবা নৌকা চালানোর মতো পেশাগুলোর চেয়ে বেশি ঝুঁকি। বাঘের হাতে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকায় ও মৃত্যুর পর স্ত্রীর ওপর অপবাদ আসার ঝুঁকি থাকায় অনেকেই এখন এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।