ক্রাইমবার্তা রিপোর্টঃ দেশের অর্থনীতির কোনো সূচকই ভালো নেই। প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। আমদানি-রপ্তানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধিই নেই, রাজস্ব আয়ে রয়েছে বড় ঘাটতি। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিপদ সংকেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিছু সেক্টরে দেখা যাচ্ছে কালো মেঘ। অন্যদিকে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতির ফলে সরকারকে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ তো বহু বছর ধরেই স্থবির। সরকারের ঋণ নেয়াতে শিল্প বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
প্রভাব ফেলছে ব্যাংক খাতেও। এমনকি মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব পড়ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারের সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মানবজমিনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে বলেন, দু’টি কারণে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতি। সে ঘাটতিটা পূরণের জন্য সরকারকে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর তা একটু ভিন্ন। অন্য বছর দেখেছি যে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ পেতো। এবছর সঞ্চয়পত্র আছে কিন্তু সঞ্চয়পত্রের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এখানে বড় অ্যামাউন্ট এর উপরে রেস্ট্রিকশন আছে। তাছাড়া বিভিন্ন টিআইন নাম্বার দিতে হয়, আইডি দিতে হয়, যে কারণে কমপ্লায়েন্স বেড়ে যাওয়াতে এখানে ডিপোজিটটা অনেক কমে গেছে। ডিপোজিট কমাতেও চাপ পড়েছে ব্যাংকিং খাতের ওপর। এই দু’টি কারণে মূলত সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
সরকারের ঋণ নেয়াতে ব্যাংক খাতে কিরূপ প্রভাব ফেলবে এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতে সরাসরি প্রভাব না পড়লেও যে প্রভাবটা পড়বে সেটা হলো বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহকে কমিয়ে দেবে। মূলত ব্যাংকিং খাতে ঋণের সোর্স হচ্ছে ডিপোজিট গ্রোথ। ডিপোজিট গ্রোথ কিন্তু বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই বেশ কমে আসছে। ডিপোজিট কমাতে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতাটাও কমে গেছে। সেই কন্টেক্সটে ব্যাংক থেকে সরকারকে ব্যাপক পরিমাণে ঋণ দেয়া এবং একই সঙ্গে ব্যক্তি খাতে ঋণের চাহিদা মেটানো, দু’টি কিন্তু পারস্পারিক সাংঘর্ষিক। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার বেশ মোটা দাগের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকিং খাত থেকে। এটাকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মনে করছে নিরাপদ, এখানে ডিফল্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই, লোন লোসের প্রভিশনের কোন সুযোগ নেই এবং এখানে রাখলে লিকুডিটি প্রভিশনও করতে হয় না। অর্থাৎ সেখান থেকেও তাদের সাশ্রয় হচ্ছে। সবমিলিয়ে এটা একটি ভালো বিনিয়োগ মনে করে তারা। এখান থেকে বেসরকারি খাতে গেলে বেসরকারি খাতে ঋণটা খারাপ হয়ে যেতে পারে। বেসরকারি খাতে বিভিন্ন সমস্যা আছে, সেক্টর স্পেসিক বিভিন্ন সমস্যা আছে। বেসরকারি খাত শক্তিশালী অবস্থায় নেই এবং এট্রাক্টিভও নয়। ফলে ব্যাংকগুলো কিন্তু সরকারকে টাকাটা দিয়ে দেবে। তাহলে ব্যাক্তিখাতের প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা পাবে কোথা থেকে? আমার চিন্তাটা ওটাই যে তাহলে সরকারতো ব্যক্তি খাতের টাকাটা ক্রাউড আউট করে ফেলছে, খেয়ে ফেলছে। সেটা কিন্তু আমাদের যে প্রবৃদ্ধি সেটার জন্য সহায়ক হবে না।
খেলাপি ঋণের সমস্যা দেশের জন্য বড় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে দেখা গেছে যে, যখনই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায় অর্থনীতি তখন ঝিমিয়ে পড়ে। এতে ব্যাংকগুলো তাদের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর আর্থিক খাত যখন ঝিমিয়ে পড়ে তাহলে প্রকৃত খাত যেটা সেটা কিন্তু তার কর্মচঞ্চল রাখতে পারে না। কারণ রিয়েল খাত চলতে হলে টাকার দরকার। টাকাটা আসবে আার্থিক খাত থেকে। সে টাকাটা যদি না আসে তাহলে তো হবে না। একটা গাড়ির ইঞ্জিনে যেমন শুধু পেট্রোল দিলে চলবে না, ইঞ্জিন ওয়েল দিতে হবে যাতে ইঞ্জিনটা ভালোভাবে চলতে পারে। সেই ইঞ্জিন ওয়েলটা যদি আমরা না দিতে পারি, সেটাতো আসতে হবে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর থেকে। তা না হলে কিন্তু প্রকৃত খাত সেভাবে চলতে পারবে না।
বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা বা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কিংবা পাচার রোধ করা যেটাই হোক না কেন, এটা যদি পারা যেত তাহলে তো অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু পারাটা কঠিন। এটা পারা যাবে কি-না সেটাই হলো প্রশ্ন। আর পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনাটা আরো কঠিন।
তিনি বলেন, মানুষ কেন বাংলাদেশ থেকে টাকা বাইরে নিয়ে যাবে সেই ইন্সেনটিভ জানতে হবে। মানুষতো এমনিই বাইরে টাকা নিয়ে যায় না। কোন একটা কারণে নেয়। সেটা তার কন্টেক্সটে সংগত। হয়তো আইনের দৃষ্টিতে বেআইনি। কিন্তু ব্যক্তি দৃষ্টিতে সেটা সংগত। কারণ এটা হতে পারে যে, সেটা অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা। এই অসৎ উপায়ে অর্জিত টাকা যাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। তাহলে এটাকে কন্ট্রোল করা যাবে।
তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তারা অসৎ উপায়ে বিত্তশালী হোন, প্রচুর অর্থের মালিক হোন তারাতো টাকা পাঠাবেই। রাজনীতিবিদরা কমিশন বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছেন তারাওতো টাকা পাঠাবেন এবং তাদের অনেক অর্থ কিন্তু কমিশন হিসেবে বিদেশেই জমা হয়ে যায়, দেশেও আসে না। কাজেই টাকা পাচারটা যেখানেই অনৈতিক অন্যায্য এবং বিভিন্ন বেআইনিভাবে ব্যাপক টাকা অর্জিত হয় সেখানে টাকা পাচার রোধ করা যায় না। এক্ষেত্রে সরকারের তেমন বড় পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুই একটি হঠাৎ হঠাৎ ঘটনা দেখি। মানুষ তখন উৎসাহী হয়। কিন্তু একটা দুইটার পর তা থেমে যায়। এতে যে মূল হোতারা, যারা কলকাঠি নাড়ান তাদের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ছোট আকারের যে দুর্নীতিগুলো হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেটা শুধু দুর্নীতিই, সেটার সঙ্গে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু এটার বাইরে রাজনীতিক সম্পর্ক আছে। যেমন কমিশন বাণিজ্য। বড় আকারের লেনদেন। এগুলোতে কিন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। সম্প্রতি পত্রিকায় আসছে পাপিয়া নামের একজন নারীর কথা। সেখানে কিন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এগুলো তারা করে। তার বিরুদ্ধে কিন্তু টাকা পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে।
তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তা থাকলে পাচার রোধ সম্ভব।
কিন্তু কিছু লোকদের ক্ষেত্রে যেমন বিএনপি বা অন্যদের ক্ষেত্রে করলাম আর নিজেদের লোকদের ক্ষেত্রে করলাম না। তাহলে তো রাজনৈতিকভাবে এটা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সরকার ব্যাংক কমিশন গঠন করতে চায়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ব্যাংক কমিশন গঠন করলেই যে এতে সুশাসন ফিরিয়ে আসবে, সমসা সমধান হবে তা নয়, আমি মনে করি কমিশন করুক, কমিটি করুক যেটাই করুক না কেন এটা সরকারকেই করতে হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। যাদেরকে দিয়েই করুক না কেন তাদের ক্ষমতায়ন করতে হবে।
কমিটি যেন শক্তিশালী হয় সেটাও লক্ষ্য করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের জন্য যেকোনো কমিটি করলে হবে না। বলা হচ্ছে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে নিয়ে কমিশন হবে। সেটা খুব ভালো। কিন্তু কমিটিতে যেন উনার পছন্দের এবং ভালো ভালো লোক দিয়ে দেয়া হয়। শুধু চেয়ারম্যানকে ভালো দিলাম আর বাকিদের দিয়ে সেটাকে অকার্যকর করে ফেললে কিন্তু হবে না। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাই প্রধান। কমিশন ভালো লোক দিয়ে করতে হবে যারা এই খাতে দক্ষ।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার ৮ শতাংশেরও বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলে থাকে। কিন্তু আমাদের সব সূচক নিম্নগামী। সেখানে ৮ শতাংশ জিডিপির সম্ভাবনা নেই। কারণ আমাদের দেশের সব সূচক নেগেটিভ। আমদানি নেগেটিভ, রপ্তানি নেগেটিভ যেটা কোন বছর হয়নি। রাজস্ব আয় খুব কম, ঋণের প্রবাহ কম, সব সূচকই কম অথচ জিডিপি এতো উপরে উঠে যাবে এটা সাংঘর্ষিক। সেজন্য আমরা মনে করি ৮ শতাংশ তো হবেই না।
সরকারের অনেকেই বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর, লাস ভেগাস বা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। এটা তারা কিভাবে বলেন আমার জানা নাই। সিঙ্গাপুরের পার ক্যাপিটাল ইনকাম হলো ৬১ হাজার ডলার, আর আমাদের পার ক্যাপিটাল ইনকাম হলো ২ হাজার ডলার। সিঙ্গাপুরের একটা ব্যাংক ডিবিএস (ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব সিঙ্গাপুর) সেখানে ১৬টি ব্যাংকে তাদের অ্যাসেট হলো ৩৩৩ বিলিয়ন ডলার, আর আমাদের বাংলাদেশে ৬০টি ব্যাংক যোগ করেও যদি অ্যাসেট করা হয় সেটা হবে ১১০ বিলিয়ন ডলার। সিঙ্গাপুর হলো পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র তাদের সঙ্গে তুলনা করা অসমীচীন।
তিনি বলেন, এসডিজিতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে। কিন্তু এখানে প্রতিবন্ধকতা অনেক বেশি। প্রধানত আমাদের আর্থিক সমস্যাটা ব্যাপক। এই রাজস্ব দিয়ে এটাকে বাস্তবায়ন করতে পারবো না। এটা সরকারকে অনুধাবন করা উচিত।
দেশের সমস্ত আর্থিক বিষয়ে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে বিপদ সংকেত লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে কিছু কিছু সেক্টরে অবশ্যই কালো মেঘ দেখতে পাচ্ছি। সেটা হলো আর্থিক খাত, রাজস্ব খাত, বেকারত্ব বৃদ্ধি কিংবা শিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধি হচ্ছে। এই চাপগুলো কিন্তু ধীরে ধীরে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আরও ঘনীভূত হবে যদি এটাকে থামানো না যায়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে নিশ্চয়ই। তবে সেটা কতো কিভাবে কত হারে কত দ্রুত এগিয়ে যাবে, সেটা কিন্তু ডিপেন্ড করবে আমরা কত কঠোরভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সংস্কার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবো তার ওপর ডিপেন্ড করে।
গণতন্ত্র এবং টেকসই উন্নয়ন পরস্পর সহায়ক। আবার গণতন্ত্র থাকলেই যে উন্নয়ন হবে তা নয়। সরকারের একাউন্টিবিলিটি থাকতে হবে। শুধু গণতন্ত্রের নাম নিলে তো হবে না, কার্যকর করতে হবে। সরকারকেই প্রমাণ করতে হবে যে তারা টেকসই উন্নয়ন জনগণকে দিতে পারে। আর টেকসই গণতন্ত্রও সরকারই দিতে পারে।