চোরাচালানি হাফিজুর রহমান মন্টু ১০ কোটি টাকার চোরাচালান পণ্যসহ আটক ১১জন

ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ কুয়াকাটার দক্ষিণপূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের বয়ারচর এলাকায় কোস্টগার্ডের হাতে ট্রলারভর্তি ১০ কোটি টাকার অবৈধ ভারতীয় থ্রি-পিচ ও শাড়ীসহ আটককৃত সাতক্ষীরার ১১জনসহ ১৩জন চোরাচালানীকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। রোববার বিকেলে আদালতের মাধ্যমে তাদেরকে পটুয়াখালি জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
গ্রেপ্তারকৃত চোরাচালানীরা হলেন, সাতক্ষীরা সদরের হাড়দ্দাহ দক্ষিণপাড়ার আবুল হোসেনের ছেলে রবিউল ইমলাম রবি (৩৬), তার ভাই মৃত সবুর হোসেনের ছেলে রাব্বি (১৭), একই গ্রামের হাানিফ সরদারের ছেলে আসাদুল ইসলাম (৩৮), গোলাম হোসেনের ছেলে রনি (২৪), দেছারউদ্দিনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন (৩২), আব্দুল মাজেদের ছেলে সাইফুল ইসলাম (৩৩), হামিদউদ্দিনের ছেলে খাদিমুল ইসলাম (৪০), মুনসুর আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম (৪০), নূর মোহাম্মদের ছেলে জাকির হোসেন (৪০), মহিদউদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন (২৮), আরশাদ আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম (৪৩)।
কোস্টগার্ডের বরাত দিয়ে পটুয়াখালি জেলার মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহাবুবর রহমান জানান, ২৭ ফেব্রুয়ারি কুয়াকাটা বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে বয়ারচর এলাকার সাগর থেকে একটি ট্রলারভর্তি ভারতীয় ত্রি-পিছ ও শাড়ীসহ ১৩জন চোরাচালানীকে আটক করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের অপারেশন অফিসার লে. ওয়াশিম আকিল জাকিরের নেতৃত্বাধীন কোস্টগার্ড সদস্যরা। পরে আটককৃত সাতক্ষীরার ১১জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অবৈধ মালের মালিক সাতক্ষীরা সদরের হাড়দ্দহ গ্রামের হাফিজুর রহমান মন্টু বলে জানা গেছে। আটককৃত মালের মূল্য সাড়ে ১০ কোটি ও ট্রলারের মূল্য সোয়া কোটি টাকা দেখানো হয়েছে জব্দ তালিকায়। তাদেরকে হাজির করিয়ে রোববার সকালে থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (বি) ধারায় কোস্টগার্ড মামলা দেওয়ার পর বিকেলে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে পটুয়াখালি জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্তভার উপপরিদর্শক মনির হোসেনের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
সরেজমিনে রোববার দুপুরে হাড়দ্দাহ দক্ষিণপাড়ায় গেলে আটককৃত রনি হোসেনের মা আঞ্জুয়ারা বলেন, এক মাস আগে রনি বাড়ি থেকে কাজ করতে যাওয়ার কথা বলে চলে যায়। ২৭ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে খবর পান যে তার ছেলে কুয়াকাটায় চোরাচালানী পণ্যসহ আটক হয়েছে। আটককৃত সাইফুল ইসলামের ভাই হাফিজুর রহমান ও দেলোয়ারের ভাই আবু তালেব জানান, এক মাস আগে বাইরে কাজ করার নামে তাদেরর ভাইরা বাড়ি থেকে চলে যায়। মাঝে মাঝে মোবাইলে তাদের কথা হতো। কোথায় আছে জানতে চাইলে এক এক সময় এক এক জায়গার নাম বলতো। কোস্টগার্ড ট্রলার ভর্তি কাপড়সহ তাদেরকে আটক করেছে মর্মে ২৮ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে জানানো হয়। রফিকুলের ভাই ইয়াকুব ও ইসমাইলের ভাই বাকী বিল্লাহ বলেন, যার চোরাচালানি পণ্য বহনের কাজে তাদের ভাইদের ব্যবহার করা হয়েছিল সেই হাফিজুর রহমান মন্টু বলেছেন, তার নিজের ভাই ও ভাইপো ধরা পড়েছে। তারা ছাড়া পেলে তোমাদের ভাইরা ও ছাড়া পাবে।
তবে অপর আটককৃত জাকিরের ভাই আবু সাঈদ ও নজরুলের ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, মন্টু খুলনায় থাকায় আসাদুল স্থানীয়ভাবে লোক ঠিক করে অবৈধ মাল ভর্তি ট্রলারে পাঠায়।
ভোমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও ভোমরা বন্দর ১৯৬৪ নং হ্যা-েলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি দক্ষিণ হাড়দ্দাহ গ্রামের আশরাফুল ইসলাম বাবলু বলেন, কোস্ট গার্ডের হাতে কুখ্যাত চোরাচালানী মন্টুর এক ভাই, এক ভাইপোসহ ১১জন ট্রলার ভর্তি ভারতীয় কাপড় নিয়ে আটক হয়ে রোববার জেলে গেছেন বলে তিনি শুনেছেন। বাবর আলীর ছেলে সামছুর তাদেরকে জামিনে মুক্ত করার জন্য দায়িত্ব পালন করছেন বলে তিনি জেনেছেন।
সীমান্ত গ্রামবাসি জানায়, আবুল হোসেন দক্ষিণ হাড়দ্দাহ এলাকার চোরাঘাট মালিক ছিলেন। ছেলে হাফিজুর রহমান মন্টু খুলনার বহুল আলোচিত কালিবাড়ি বাজারের চারতলা মার্কেটের মালিক ব্লাকার সামছুর ফাই ফরমাস খাটতেন। এরশাদ শিকদারের ফাঁসি হওয়ার পর ব্লাকার সামছু তার চোরাচালান সম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। ব্লাকার সামছু’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ায় তিনি ঢাকায় যেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এ সময় সাতক্ষীরা থেকে চোরাচালানী পণ্য ঢাকাসহ সারা দেশে পাঠানোর মালিক ছিলেন হাদদ্দাহ এর হাফিজুর রহমান মন্টু ও কালিগঞ্জের নলতা ইন্দ্রনগরের কোটিপতি ছিদ্দিক মোড়ল। সুন্দরবনের খোলপেটুয়া নদীতে ট্রলারসহ তিন কোটি টাকার কাপড় ধরা পড়ায় ২০১০ সালে ব্লাকার সামছু, মন্টু ও ছিদ্দিক মোড়লের নামে মামলা হয়। ওই মামলায় সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে ছিলেন ব্লাকার সামছু। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর মন্টু ও ছিদ্দিক মোড়লের চোরাচালানী পণ্য ভোমরার এক নেতা শহীদুল নদীপথে নিরাপদে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব নেন। খুলনার দায়িত্বে ছিলেন রেলগেটের বাচ্চু। এসব অবৈধ পণ্য পরিবহনের কাছে বহিরাগত শ্রমিক লাগালেও ২০১৪ সাল থেকে মাদকাসক্ত আসাদুল স্থানীয় শ্রমিকদের ওই কাজে ঢুকিয়ে দেন। কোলকাতার খিদিরপুর ডক থেকে বরিশাল বা ভোলা বা পটুয়াখালি পর্যন্ত একটি ট্রিপের জন্য একজন শ্রমিককে মন্টু দেন ১০ হাজার টাকা। মন্টু খুলনার পাওয়ার হাউজে অবস্থান করলেও প্রতি ট্রলারের দিক নির্দেশনা দিত তার ভাই রবিউল ইসলাম। এছাড়া ট্রলার সশস্ত্র পাহারায় থাকে চারজন। গত ডিসেম্বরে পাইকগাছায় মন্টুর কাপড় ভর্তি ট্রলারসহ কয়েকজনকে পুলিশ আটক করলেও ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। কুয়াকাটা ও পটুয়াখালি থেকে ডাঙা পথে ওইসব পণ্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করার জন্য আসাদুল বিশেষ সময়ে মন্টুর পাজারু ও প্রাইভেট ব্যবহার করে থাকে।
তারা আরো জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার সীমান্তবর্তী (হাড়দ্দাহ এর বিপরীতে) শাকচুড়া গ্রামের আব্দুল লতিফের মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে বাড়ি বানিয়েছেন মন্টু। তার দু’ছেলে সেখানে। ভারতীয় চোরাচালানী পণ্য বাংলাদেশের সীমান্ত পর্যন্ত পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে শাকচুড়ার শ্যালক মিঠু। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মন্টুর ছয় চালান মাল নিরাপদে পার হলেও ২৭ ফেব্রুয়ারি ধরা খেয়েছে কুয়াকাটায়। হাড়দ্দাহ ছাড়াও কুলিয়াতে বিলাসবহুল বাড়ি বানাচ্ছেন মন্টু। এখন স্থাবর ও অস্থাবর মিলে ১০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ। চোরাচালানের ছয়টি মামলায় মন্টু সাতক্ষীরা, শ্যামনগর ও খুলনায় জেল খেটেছেন।
এ ব্যাপারে শহীদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে আসাদুল বলেন, ভাই সিএ-এফ হিসেবে ভোমরা বন্দরে কাজ করে থাকেন। তিনিও বন্দরে শ্রমিক নেতা। এলাকার মানুষ হিসেবে চোরাকারবারি মন্টুর গাড়িতে ওঠার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, এর বাইরে তাদের সঙ্গে মন্টুর কোন সম্পর্ক নেই। হাফিজুর রহমান মন্টু রোববার দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, তার ভাই ও ভাইপোসহ এলাকার কয়েকজন কুয়াকাটায় ভারতীয় কাপড়সহ ধরা পড়েছে মর্মে তিনি শুনেছেন। এর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই দাবি করে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে চোরাচালানের অভিযোগ ঠিক নয়।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।