বিজিএফসিএলের প্রকল্পে দুর্নীতির মাশুল ঝুঁকিতে বছরে ২৫শ’ কোটি টাকার গ্যাস উত্তোলন কম্প্রেসার বসানো না হলে এক বছরে বন্ধ হবে ৫টি গ্যাসকূপ

ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোটঃ গভীর সংকটে পড়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্র তিতাস। সেখানে দ্রুত কমে যাচ্ছে গ্যাসের চাপ (রিজার্ভার প্রেসার)। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ক্ষেত্রটির ‘লোকেশন-১’-এর ৫টি কূপের।

বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। এতে আরও বলা হয়েছে, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চাপে এসব কূপ থেকে প্রায় এক বছর পর্যন্ত গ্যাস তোলা সম্ভব হবে। এরপর দৈনিক ২০ কোটি (২০০ মিলিয়ন) ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাবে, যার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সময়মতো ‘কম্প্রেসার’ বসাতে না পারার কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এমন পরিস্থিতির। এ জন্য বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডের একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা লোকেশন-১-এর ৫টি কূপে কম্প্রেসার বসানোর জন্য দরপত্র আহ্বানে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যার কারণে দরপত্র আহ্বান করেও চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। ফলে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে বছরে ২৫০০ কোটি টাকার গ্যাস উত্তোলন।

আরও জানা গেছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস উত্তোলন অব্যাহত রাখার জন্য তিতাসের এই ৫টি কূপে ‘ওয়েলহেড কম্প্রেসার’ বসানোর একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ায় বছর খানেকের মধ্যে সেখান থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা ক্ষেত্রটির পরিচালনা সংস্থা বিজিএফসিএল সংশ্লিষ্টদের।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বিদেশি কোম্পানি শেল অয়েলের কাছ থেকে ৫টি গ্যাসক্ষেত্র কিনেছিলেন। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হচ্ছে তিতাস। কিন্তু মুজিববর্ষে এই গ্যাসক্ষেত্রে সৃষ্ট এমন নাজুক পরিস্থিতির জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ক্ষেত্রটি থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার টিসিএফ গ্যাস তোলা হয়েছে। এখনও ক্ষেত্রটিতে প্রায় সমপরিমাণ গ্যাসের মজুদ রয়েছে। কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্র থেকে গ্যাস তোলার একটা পর্যায়ে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে এবং এক সময় আর স্বাভাবিক চাপে গ্যাস তোলা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসিয়ে গ্যাস তোলা অব্যাহত রাখতে হয়। তিতাসেও সেই ব্যবস্থা নিতে ২০১৬ সালে বিজিএফসিএল ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি সমীক্ষা চালায়। ওই সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়েলহেড কম্প্রেসর বসানো না হলে আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৯-২০২১ সালের মধ্যে ক্ষেত্রটির লোকেশন-১-এর ৫টি কূপ থেকে স্বাভাবিক চাপে গ্যাস তোলা বন্ধ হয়ে যাবে।

এই পরিস্থিতি যাতে না হয়, সে জন্য এডিবির আর্থিক সহায়তায় বিজিএফসিএল ওই ৫টি কূপে ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসানোর প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ওই ৫টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের হার দৈনিক ৩০ কোটি ঘনফুট থেকে কমে ২০ কোটি ঘনফুটে দাঁড়ায়।

৫টি কূপে কম্প্রেসার বসানো হলে গ্যাস উত্তোলন আবার ৩০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত হতো। কিন্তু জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার ব্যর্থতার কারণে দরপত্র প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে এসে সেটি বাতিল করে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

বিজিএফসিএল সূত্র জানায়, পুনরায় দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করে ওয়েলহেড কম্প্রেসার বসাতে অন্তত ২ বছর সময় লাগবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে ক্ষেত্রটির লোকেশন-১-এর অবস্থা কী হবে, আগের হিসাবে নির্ধারণ করা কম্প্রেসারগুলো কাজ করবে কি না, তা পুরোপুরি অনিশ্চিত।

কম্প্রেসার স্থাপনের দরপত্রে অনিয়ম : বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) তিতাস লোকেশনে সাতটি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপন প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। টেকনোস্টিম এনার্জি নামে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিতর্কিত একটি কোম্পানির কারণে ওই দরপত্র ভেস্তে গেছে। জানা গেছে, যাচাই-বাছাই না করেই তড়িঘড়ি করে বিজিএফসিএল ওই টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যু করেছিল।

কিন্তু নোয়া ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে কোম্পানিটি চুক্তি করতে পারেনি। জমা দিতে পারেনি দরপত্রের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) টাকাও। কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজের প্রতারণার কারণে দরপত্রের সঙ্গে জমা দেয়া সাড়ে ১২ কোটি টাকার বিডবন্ডটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়।

কার্যাদেশ দেয়ার আগমুহূর্তে কোম্পানিটি নিয়ে এমন বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হয়ে বড় ধরনের বিপাকে পড়ে বিজিএফসিএল। বারবার চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া না পাওয়ায় বিডবন্ডের সাড়ে ১২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করতে গিয়েও দেখা যায় সেটির মেয়াদ নেই। পরবর্তী সময়ে পাইপলাইনার্স নামে তৃতীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে পারফরম্যান্স সিকিউরিটি (পিজি) নিয়ে টেকনোস্টিমকে কার্যাদেশ দেয়ার চেষ্টা করলেও পরিচালনা পর্ষদ সেটি আটকে দেয়। সিদ্ধান্ত নেয় নতুন করে দরপত্র আহ্বানের।

অভিযোগে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির লেটারহেড প্যাডে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে অর্থাৎ টেন্ডার আহ্বানের পর কোম্পানিটির ওয়েবসাইট খোলা হয়েছে। দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তারা যেসব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছে, বাস্তবে কোম্পানিটি সেরকম কোনো কাজই করেনি।

বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিকুর রহমান তপু যুগান্তরকে বলেন, আগের টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের বিষয়ে এডিবির কাছে পরামর্শ চেয়ে চিঠি দিয়েছি। এডিবি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।

সূত্র আরও জানায়, তিতাস লোকেশন ‘এ’-তে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।

কারণ, এই ৭টি কূপে গ্যাসের চাপ কমে গিয়েছিল। কম্প্রেসার বসানো হলে কূপগুলো থেকে আগের মতো গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয় ২০১৬ সালে। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানি তিতাসের ৭টি গ্যাসকূপের ওয়েলহেড কম্প্রেসার ডিজাইন তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্রয়, সরবরাহ, স্থাপন, টেস্টিং, কমিশনিং, অপারেশন এবং মেইনটেনেন্সের কাজ করবে।

২০১৯ সালের ৩ মার্চ দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। মোট ৭টি কোম্পানি এতে অংশ নিলেও দুটি কোম্পানি কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। কোম্পানি দুটি হল : সিঙ্গাপুরভিত্তিক এন্টার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেকনোস্টিম এনার্জি লিমিটেড। গত ৯ সেপ্টেম্বর আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন বিজিএফসিএল বোর্ডে অনুমোদিত হয়।

এরপরই ১২ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে বিজিএমসিএল সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) প্রদান করে।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।