ক্রাইমবার্তা ডেস্ক রিপোটঃ করোনা ভাইরাসের কারণে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। আশঙ্কা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চলেছে করোনা। এদিকে বাংলাদেশ এই ঝুঁকির বাইরে নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় প্রতিটি পর্যায়েই যুক্ত রয়েছে চীন। এদেশেও করোনার প্রভাব ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি সঙ্কটে দেশের ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে চীনা অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে বাধার মুখে পড়ার শঙ্কায়। বাড়তে পারে প্রকল্প ব্যয়ও। প্রভাব পড়ছে দেশের শেয়ারবাজারেও। গতকাল পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মন্দার মুখে পড়তে পারে। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ৩০২ কোটি ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার কারণে যে সংকট চলছে তাতে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বৈশ্বিক জিডিপি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। চীনের কারখানা বন্ধের প্রভাব পড়ছে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতেও। করোনার প্রভাবে বিশ্বের বড় কোম্পানিগুলোর ব্যবসা এখন নিম্নমুখী। কারণ চীন থেকে সারা বিশ্বে বেশিরভাগ কাঁচামাল সরবরাহ হয়।
চলতি অর্থবছরের শুরুতেই হোঁচট খায় দেশের রপ্তানি আয়। সেই হোঁচটের নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে রপ্তানিখাতে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে রপ্তানিখাতে যে আয় হয়েছে, তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২.৭২ শতাংশ কম। অর্জিত এ আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৭৯ শতাংশ কম। অর্থবছরের বাকি চার মাসেও রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফিরবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
এদিকে করোনা প্রাদুর্ভাবের প্রভাব পড়েছে দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে। এতে ২০১৯ সালের জানুয়ারির তুলনায় চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রায় ২ লাখ টন ও ২০১৮ সালের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ১০ হাজার টন পণ্য আমদানি কমে গেছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, নগদ প্রণোদনা ও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও রপ্তানি আয় কমছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিকসহ বড় খাতে আয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সার্বিক রপ্তানিখাতে। এছাড়া বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কম থাকায় অর্ডারও কমছে। সঙ্গে পণ্যের মূল্যও কমে গেছে। পাশাপাশি দেশের অবকাঠামোগত সমস্যা, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা রয়েছে। আগামীতে এ অবস্থা হবে আরো ভয়াবহ। কারণ এরই মধ্যে বিশ্ববাজারকে কাঁপিয়ে দিয়েছে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস। চীন ছাড়িয়ে এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকা- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া এ মহামারি যদি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে, তাহলে রপ্তানি বাণিজ্য বড় ক্ষতির মুখে পড়বে।
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোয় সর্বোচ্চ ১ থেকে ২ মাসের কাঁচামাল মজুদ থাকে। বড় কারখানাগুলোয় থাকে ৩ মাসের। কিন্তু করোনার কারণে আমদানি বন্ধ থাকলেও এতদিন ধরে উৎপাদন চলায় অনেক কারখানার মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পুরো রপ্তানির ৮০% তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের প্রায় ৬০শতাংশই কোন না কোনভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। আর এসব পণ্য উৎপাদন করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ অর্থবছরের শুরু থেকে বলে আসছি তৈরি পোশাকের ব্যবসা কম। বিশ্ববাজারে পোশাকের ব্যবসা কমছে। শুধু তাই নয়, আগের তুলনায় আমাদের ব্যবসাও ৫ শতাংশ কমে গেছে। সব মিলিয়ে পোশাক খাত বড় চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতি হতে পারে প্রায় ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যার পরিমাণ বৃটেনের মোট জিডিপির সমান। এর ফলে মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান ও চীন। ব্লুমবার্গ ইকোনোমির গবেষণা বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানি। আসন্ন এক সংকটের মুখের বিশ্ব অর্থনীতি। এটি আরো নির্ভর করছে করোনা নিয়ে সরকারগুলোর পদক্ষেপের ওপর। এ ভাইরাসের কারণে চীনে গাড়ি বিক্রি কমে গেছে ৮০ শতাংশেরও বেশি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেমে এসেছে মাত্র ১৫ শতাংশে। ব্যবসার গতি সর্বনিম্ন অবস্থানে আছে। ব্লুমবার্গ ইকোনোমি বলছে, চীনের জিডিপি এ বছর ১.২ শতাংশ কমে আসবে। যদি মার্চের মধ্যে চীন এখান থেকে উঠে আসতে না পারে তাহলে অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
তবে ব্লুমবার্গ বলছে, এখনো বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করা হয়নি করোনা ভাইরাসকে। তবে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে সার্বিক পরিস্থিতি। বিশ্বের দেশগুলোর অবস্থা তখন চীনের মত ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদি তাই ঘটে তবে হিসেব বলছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২০২০ সালে শূন্যে নেমে আসবে। প্রবল মন্দা দেখা দেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানেও।
একইরকম পূর্বাভাস দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফও। এর আগে এ বছর বিশ্বে প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছিল ৩.৩ শতাংশ। তবে করোনার কারণে এটি কমে ০.১ শতাংশ হতে পারে বলছে আইএমএফ। বিমান পরিবহণ সমিতি আইএটিএর হিসেবে, এবার বিমান পরিচালনা সংস্থাগুলো প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যাত্রী কমে যেতে পারে গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশেরও বেশি। এরইমধ্যে প্রতিদিন বাতিল হচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি ফ্লাইট।
এর আগে কোনো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিই বিশ্বব্যাপী এমন অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা সৃষ্টি করেনি। চীন খারাপ থাকলে বিশ্বের কোনো দেশই স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারবে না। তবে করোনা এখন বিশ্বব্যাপী ছড়াচ্ছে। ভুগতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, জার্মানি ও ইতালির অর্থনীতি। ভারতের অর্থনীতিও ভারসাম্য হারাতে বসেছে। একই অবস্থা ইন্দোনেশিয়া ও জাপানেও। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের পরিসংখ্যান বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। এরইমধ্যে এর প্রভাব সপষ্ট হচ্ছে।
করোনা থেকে বাঁচতে আগাম যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে তাতেই থমকে যাচ্ছে অর্থনীতি। এতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটন, আমদানি-রপ্তানি, যাতায়াত। দ্রুত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক অর্থনৈতিক খাত। অনেকগুলো ধীরে ধীরে চলছে। সরবরাহ চেইন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারেও। চলছে অব্যাহত সূচকের দরপতন।