ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, কুড়িগ্রামে মধ্যরাতে বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে ধরে এনে নির্যাতন চালানোর পর মাদক দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়ার ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এ অভিযোগের সঙ্গে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে তদন্তে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত অন্যদেরকেও প্রত্যাহার করা হবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
রোববার বেলা আড়াইটার দিকে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
ফরহাদ হোসেন বলেন, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক পরিকল্পিতভাবে যে ঘটনাটি ঘটিয়েছেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেয়েছে মন্ত্রণালয়। তারই ভিত্তিতে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রত্যাহারের আদেশ স্বাক্ষরিত হয়নি। স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি আগেই বলছি না।
‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। সুতরাং তারও কনসার্নের বিষয় রয়েছে। তিনি এরই মধ্যে শুনেছেন এবং এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। আশা করছি, বিকেলের মধ্যে প্রত্যাহারের একটি আদেশ হাতে পাওয়া যাবে’-যোগ করেন প্রতিমন্ত্রী।
এক প্রশ্নের বিষয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, সুলতানা পারভীনে এই কাজের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনের সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি ভুল কাজ করেছেন। এখন তার ভুলের জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে জানিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, তার প্রথম যে ন্যুনতম শাস্তি তা হলো প্রত্যাহার করে নেয়া। সেটি হচ্ছে। এরপর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। তার ভিত্তিতে বিভাগীয় তদন্ত হবে আবারও। সে অনুযায়ী তার বিচার হবে। শাস্তি হবে।
স্থানীয়রা জানান, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই ডিসি আরিফের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
শুক্রবার মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে আনেন জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট। তাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, মাদকবিরোধী অভিযানে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে ৪৫০ গ্রাম দেশি মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে।
তবে সাংবাদিক আরিফের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদারের অভিযোগ, শুক্রবার রাত ১২টার দিকে একদল লোক দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে ‘তুই খুব জ্বালাচ্ছিস’ বলে আরিফুলকে পেটাতে থাকে। এ সময় তাকেও গালাগাল করা হয়। একপর্যায়ে কয়েকজন মিলে টেনেহিঁচড়ে আরিফকে তুলে নিয়ে যায়। তাকে জামাও পরতে দেয়া হয়নি। সকালে তিনি জানতে পারেন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে আরেক দফা মারধরের পর সাজানো অভিযোগে আরিফুলকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে শনিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়। রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কেএম তারিকুল ইসলাম তদন্তের দায়িত্ব দেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) আবু তাহের মো. মাসুদ রানাকে।
রাতের বেলা এভাবে সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়ার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।
আরিফুল অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি। তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কুড়িগ্রাম শহরের চড়ুয়াপাড়ায় থাকেন। গত শুক্রবার রাতে সেই বাড়িতেই অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। অভিযানের বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার দাবি করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স অভিযান চালিয়েছে। আর আরিফুল ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে দোষ স্বীকার করায় তাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
আরিফুলের স্ত্রীর অভিযোগ, শুক্রবার রাতে তারা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় দরজায় আঘাত। একপর্যায়ে আরিফুল যখন সদর ওসিকে ফোন দেয়ার চেষ্টা করেন, তখনই সবাই ঢুকে পড়ে। এ অভিযানে অন্তত ৪০ জন ছিল। তিনি বলেন, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন কিছু দিন আগে একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করেন। এ নিয়ে আরিফুল প্রতিবেদন করেন। এ ছাড়া জেলায় নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এতে জেলা প্রশাসকসহ অনেকে ক্ষুব্ধ হন।
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার নামে কোনো পুকুরের নামকরণ হয়নি। এক বছর আগে এমন প্রতিবেদন করেছিলেন আরিফুল। এ জন্য তিনি ক্ষমাও চেয়েছিলেন।’
অভিযানের বিষয়ে তার ব্যাখ্যা হচ্ছে– ‘অ্যাজ ইউজুয়াল টাস্কফোর্স অভিযানে গেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের কয়েকজন ফোর্স, ব্যাটালিয়ন আনসারের পাঁচজন আর মাদকদ্রব্যের তিনজন ছিলেন। মাদকদ্রব্যই আমাদের কাছে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছিল।’