ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন ও অনলাইন নিউজপোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম রিগানকে নির্যাতনকারী আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নাজিমউদ্দীন কক্সবাজার ও মাগুরার মহম্মদপুর থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন। নাজিম উদ্দীনের হাতে বিভিন্নভাবে নির্যাতিতরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। খোঁজ নিলে ভুক্তভোগীরা ওই ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
সাদা শার্ট ও লুঙ্গি পরা এক বৃদ্ধের কলার চেপে ধরে খেতের আল ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি। সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে নির্যাতনের রোমহর্ষ বর্ণনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর এমন একটি ভিডিও আবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। নেটিজেনরা জানতে পারেন, ছবির ওই নির্যাতক কুড়িগ্রামের বর্তমান রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন। তবে ভিডিওর ঘটনাটি কক্সবাজারের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেটিজেনরা মন্তব্য করছেন, শুধু বদলি না করে নাজিম উদ্দীনের ওই সময় শাস্তি হলে কুড়িগ্রামে তিনি সাংবাদিক পেটানোর সাহস পেতেন না।
রোববার (১৫ মার্চ) জামিনে মুক্তির পর আরিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘রাতে ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন আমার মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে আমাকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। এরপর আমাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে এনকাউন্টারে দেওয়ার হুমকি দেয়। আমাকে নাজিম বারবার বলেন, আজ তোর জীবন শেষ। তুই কলেমা পড়ে ফেল, তোকে এনকাউন্টারে দেওয়া হবে।’
কক্সবাজারে ‘স্যার’ বলে না ডাকায় রোজাদার বৃদ্ধকে মাটিতে ফেলে বেধড়ক মারপিট, কিল-ঘুষি মেরে আলোচনায় আসেন এসিল্যান্ড নাজিমউদ্দীন। সেখানে থাকাকালীন ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করতেন না তিনি। বহুজনের কাজ থেকে নামজারিসহ জমি সংশ্লিষ্ট কাজের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। কক্সবাজার থেকে তাকে রাঙামাটির লংগদুতে বদলি করা হয়। সেখান থেকে বদলি করা হয় মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা ভূমি অফিসে।
মহম্মদপুরে যোগদান করেই ব্যক্তি মালিকানা জমি খাস করে সরকারি হিসেবে বরাদ্দ বাণিজ্য শুরু করেন। কোটি কোটি টাকা উৎকোচ আদায় করেন বিভিন্নজনের কাছ থেকে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে ধরে এনে পিটিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে জেল জরিমানা করতেন। জমি নিয়ে বিরোধে ওষুধ ব্যবসায়ী উপজেলা সদরের বাদশা ফকিরকে এক বছরের জেল দেন। ওই ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে বড় উৎকোচ দাবি করেন। মহম্মদপুরের কয়েকজন বলেছেন, নাজিম উদ্দীন ভূমি অফিসের কয়েকজনের সহায়তায় রীতিমতো মাস্তানি করতেন।
মহম্মপুরের ভুক্তভোগীদের একজন বাদশা ফকির বলেন, ‘আমার পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে সরকারের সাথে মামলা বিচারাধীন। এবং আদালতের রায় অনুযায়ী কোনো পক্ষই এই জমিতে যেতে পারবে না বা কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু এসিল্যান্ড নাজিমউদ্দীন আমাকে না জানিয়ে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে মার্কেটের দোকানঘর বরাদ্দ দেন ওই জমিতে। পরে পিয়ন দিয়ে আমাকে তার অফিসে ডেকে নেন। অফিসের দরজা বন্ধ করে এই ব্যাপারে আপসের কথা বলে হুমকি দেন। এতে রাজি না হয়ে আমি বাড়ি চলে যাই।
এ ঘটনার কয়েকদিন পর তিনি আমার বাড়িতে গিয়ে ভূমি অফিসের লোক নিয়ে অভিযান চালান। এ সময় অন্যায়ভাবে তিনি আমাকে ও আমার স্ত্রীকে মারধর করেন। এক পর্যায়ে আমাকে ভূমি অফিসে নিয়ে এক বছরের কারাদণ্ড দেন ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি একজন ওষুধ ব্যবসায়ী। আমি নাকি অবৈধ গর্ভপাত ঘটাই। এই মিথ্যা অভিযোগে আমাকে সাজা দেন তিনি। মূলত তার কথা না শোনায়, তিনি আমাকে সাজা দিয়েছিলেন।
এছাড়াও গত বছরের সেপ্টেম্বরে মহম্মদপুরের নহাটা বাজারের ঘরমালিক ও ব্যবসায়ীরা নাজিম উদ্দীনের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাদের অভিযোগ, বিনা নোটিশে নাজিম উদ্দীন তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। দোকানদারদের কিল-ঘুষি দিয়েছেন এবং গালিগালাজ করেছেন। নাজিম দাবি করেছিলেন, ওগুলো খাসজমিতে অবৈধ স্থাপনা।
এদিকে, কক্সবাজার সদরের এসিল্যান্ড থাকাকালীন ২০১৮ সালের মে মাসে রোজাদার এক বৃদ্ধকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে পাড়িয়েছিলেন তিনি। মাটিতে পড়ে থাকা বৃদ্ধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গেয়ে ওপর বসে কিল ঘুষি মারেন। এক পর্যায়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে করতে কান ধরে টেনে-হিঁচড়ে তুলে কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে নিয়ে যান। এ ঘটনার ভিডিও প্রকাশ হলে নাজিম উদ্দীনকে কক্সবাজার থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। নির্যাতনের শিকার ওই বৃদ্ধের নাম মোহাম্মদ আলী ওরফে নফু মাঝি। তিনি কক্সবাজার শহরের কলাতলীর মৃত কবির আহমদের ছেলে।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ঘটনার সময়টি পবিত্র রমজান মাস ছিল। আমি রোজা রেখেছিলাম। ওইদিন হঠাৎ করেই আমার ভিটেতে কয়েকজন লোক গিয়ে জমি পরিমাপ করা শুরু করেন। এ সময় আমি তাদের-‘আপনারা কারা’ জিজ্ঞেস করতেই এসিল্যান্ড নাজিম আমাকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে পাড়াতে থাকেন। আমি মাটিতে শুয়ে থাকলে এসিল্যান্ড নাজিম উদ্দীন বলেন, ‘আমাকে স্যার ডাকলি না কেন?’ এসময় তিনি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমি মাটিতে শোয়া অবস্থায় আমার বুকের ওপর বসে মারধর করতে থাকেন। আমাকে আমার বাড়ি থেকে তুলে কান ও শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে গাড়িতে তুলে এসিল্যান্ড সদরের অফিসে নিয়ে যায়।
কক্সবাজারের নাগরিক আন্দোলনের নেতা এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, এই নাজিম উদ্দীন দুই বছর আগে কক্সবাজার সদরের এসিল্যান্ড ছিলেন। দায়িত্বকালে বহু বিতর্ক জন্ম দেন। তাকে ‘স্যার’ না ডাকায় এক সংবাদকর্মীকে লাঞ্ছিত করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এক বৃদ্ধ লোককে কান টেনে শার্টের কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যান। নিজ অফিসে দরজা বন্ধ করে খালি স্ট্যাম্পে দস্তখত নেন। মিথ্যা জবানবন্দি আদায় করেন। আরো অনেক অভিযোগ। বিতর্কিত আচরণে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনকে। নাজিম উদ্দীন সাংবাদিকদের সইতে পারতেন না। তার আচরণ ছিল মাস্তানদের মতো।
নজরুল ইসলাম আরও জানান, তিনি কক্সবাজারে যেখানেই যেতেন, সাংবাদিকের ওপর চড়াও হতেন। বলতেন, সাংবাদিক নাকি তার জাতশত্রু। নাজিম উদ্দীন কক্সবাজার থেকে বদলি হওয়ার পরও বহু জনের কাজ থেকে নামজারিসহ জমি সংশ্লিষ্ট কাজের নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
নাজিম উদ্দীনের গ্রামের বাড়ি যশোরের মণিরামপুরে। ৩৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে উত্তীর্ণ হন তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দীনের মোবাইল ফোনে বার বার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত,মধ্যরাতে বাসার দরজা ভেঙে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের অফিসে নিয়ে নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আরিফুল বলেন, শুক্রবার (১৩ মার্চ) রাত ১২টার পর খেয়ে শুয়ে পড়ার পর একজন বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেন। পরিচয় জানতে চাইলে কেউ পরিচয় জানায়নি। পরে আমি সদর থানার ওসিকে ফোন দেই। ফোন দেওয়ার কথা শুনে বাইরে থাকা আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার-রাজস্ব) নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন লোকজন দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে। ঘরে ঢুকেই আরডিসি নাজিম উদ্দিন মাথায় কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। মারতে মারতে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলে। এরপর অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে এনকাউন্টার দিতে চায়। বারবার বলে, ‘তুই কালেমা পড়ে ফেল তোকে এনকাউন্টার দেওয়া হবে।
ভিডিওটি সংগৃহীত……..
https://youtu.be/VtOYzfFxgMg