ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ সাতক্ষীরা: কলারোয়ায় সরকারি প্রকল্পের ঘর নির্মাণের আগেই তোলা হয়েছে সমুদয় বিল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরএম সেলিম শাহ্ নেওয়াজ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ কমিটির অন্যান্যদের অজ্ঞাতে রেখে বিল উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। বিল উত্তোলনের বিষয় নিয়ে টেলিফোনে স্বীকার করলেও ক্যামেরার সামনে তিনি অস্বীকার করেন। এনিয়ে ক্ষুব্ধ উপজেলা চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা। উপজেলা পরিষদ চত্বরে চলছে চরম অসন্তোসও।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, কলারোয়ায় ‘জমি আছে ঘর নাই’ এমন দরিদ্র মানুষদের জন্য এক লাখ টাকার করে ৬০টি ঘরের বরাদ্দ আসে গত বছর। গেল বছরের ৩০ জুনের মধ্যে উক্ত ঘর নির্মাণ কাজ শেষ করার নির্দেশনা থাকে। গৃহ নির্মাণের ক্ষেতে ৫সদস্যের কমিটি করার জন্য নির্দেশনা থাকলেও সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন ইউএনও আরএম সেলিম শাহনেওয়াজ। এই কমিটির সভাপতি ইউএনও, সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, কমিটির অপর সদস্যরা হলেন, সহকারি কমিশনার ভূমি, উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কমিটির কাউকে না জানিয়ে ইউএনও তার বাসার মালি ফজলুকে দিয়ে মিস্ত্রি নিয়ে ইউএনও’র নিজ আঙ্গিনায় ঘরের প্লিয়ার তৈরি করেন। ইউএনও’র পক্ষে ঠিকাদার হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত বাসা বাড়ির মালির এই কাজে জনপ্রতিনিধিসহ সকলেও ফুসে উঠেছেন। এই অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন ইউএনও অফিসের বেনজির আহম্মেদ ও বাসার মালি ফজলুর রহমান ফজলু।
এবিষয়ে কথা হয় স্থানীয় সাংবাদিক আনিসুর রহমানের সাথে, তিনি জানান, উক্ত কাজের সকল কাগজপত্র হাতে নিয়েছি। তাতে দেখেছি প্রতিটি প্লিয়ারে ৪টি করে ১০ মিলি রড দেয়ার কথা থাকলেও কোনটায় একটি বা কোনটায় দুটি করে কয়েল রড দেয়া হয়েছে। আর বালি সিমেন্টের কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না-যা নি¤œমানের শেষ কোটায়। তিনি বলেন, ৯০০ ইট ৭ হাজার টাকা, মিস্ত্রি খরচ ৯ হাজার ৬শ টাকা, টিন ২০ হাজার টাকা, পিলার আর কাঠের রো বাটাম মিলিয়ে ঘর প্রতি মোট খরজ ৫০ হাজারের বাইরে যাবেনা।
এসব শুনে সম্প্রতি সরেজমিনে কলারোয়ার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক লাখ টাকার ঘর প্রাপ্ত ইশারুল ইসলামের বাড়িতে পৌছাই। শাবানার মোড় থেকে একটু ভিতরে গিয়েই দেখা যায় ইশারুলের বাড়িতে বাকসা তাঁতিপাড়ার মৃত সোবহান মন্ডলের ছেলে মিস্ত্রি হোসেন আলী কাঠ কাটা ও টিন লাগানোর কাজ করছেন। ঘর প্রতি ৬ হাজার টাকা চুক্তিতে তিনি নিয়মিত কাজ করছেন বলে জানান। কাজ শেষ হতে এখনও বেশ সময় লাগবে বলেও জানালেন তিনি। এদিকে ইশারুল তার ছেলে মেয়ে ও ছেলের বউ সবাই ঘরের অভাবে একটি ঘরের বারান্দায়সহ বিভিন্ন স্থানে থাকেন। তারা একটি ঘর পেয়ে খুশির কথা জানালেও কত টাকা বরাদ্দ তা তারা জানেনা। কথা বলতে বলতে পাশে এসে কানে কানে একজন বললেন ভাই আপনার সাথে কথা আছে। কে আপনি বলতেই বললেন আমি ফজলু, ইউএনও স্যারের কাছের লোক, স্যার খুব ভাল মানুষ। চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব দিলে গরিবদের কাছ থেকে টাকা নেয় তাই স্যার নিজেই দায়িত্ব নিয়ে করছেন। আমি দেখা শুনা করি। এজন্য স্যারকে নিয়ে নানান কথা বলছেন তারা। আপনারা স্যারের পক্ষে একটু ভাল করে লিখে দেবেন। কলারোয়া উপজেলা পরিষদে এসে উৎসুক জনতার মধ্যে সোনাবাড়ির একজন বললেন, ৬০টি ঘর দেয়ার ক্ষেত্রে কমবেশি প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ঘরের মান নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন! তিনি দরিদ্রদের ঘর দেয়ার নামে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবী জানান। একই সময়ে উপজেলা পরিষদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন সোনাবাড়িয়া কলেজের প্রভাষক আব্দুর রহিম। তিনি বলেন, উক্ত ইউনিয়নে যেসব ঘর দেয়া হয়েছে তা অত্যন্ত নি¤œমানের। যারা ঘর পেয়েছে তারাই মাটি ভরাটসহ অন্যান্য কাজ করছে। প্রায় সব ঘরই এখনও অসম্পন্ন রয়েছে অথচ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে পুরো বিল তুলে নিয়েছেন। এই কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই শিক্ষক।
একই দিন দুপুরে কেরালকাতা ইউনিয়নের কিসমত ইলিশপুর গ্রামের ঘর প্রাপ্ত ভিক্ষুক শরবানুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ৫/৬ দিন আগে মিস্ত্রি গিয়েছিল। কয়েকটা প্লিয়ার বসিয়ে কিছু টিনও উপরে লাগানো হয়েছে। তবে অনেকটাই ফাঁকা আছে। ঘরের ভিত নাই, অল্প কিছু মাটি দেয়া আছে, ঘরের চালে লাগানো রো বাটাম কিছু নতুন কিছু পুরানো। রাস্তার ধারে পড়ে আছে ইট বালু আর আমা ইটের খোয়া। কথা হয় পাশের বাড়ির এক গৃহবধুর সাথে। তিনি জানান, একদিন মিস্ত্রি এসেছিল কাজ করে চলে গেছে আর আসেনি। কবে আসবে তাও বলতে পারেনা। ওই গৃহবধু বলেন, শরবানুর একটা ছেলে সে মারা গেছে। ছেলেও বউ বাবার বাড়িতে থাকে আর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়ায় সে অন্যের ঘরের ঘরনী। ভিক্ষা করে শরবানুর দিন চলে। মিস্ত্রিরা আসবে আসবে করে না আসায় ৪/৫দিন বসে থেকে আজ গ্রামে গেছে ভিক্ষা করতে। আংশিক নির্মিত ওই ঘরের পেছনে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাক খরজ হতে পারে এমন ধারণার কথা জানালেন তিনি। ওই জায়গায় দাড়িয়ে কথা বলতে বলতে চলে আসলেন ৯নং হেলাতলা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আমিরুল ইসলাম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ঘর হচ্ছে শুনেছি, দুই ওয়ার্ডে দুটো হচ্ছে তাও শুনেছি কিন্তু কিভাবে হচ্ছে, কে করছে, তালিকা কোথায়, কত টাকা বরাদ্দ, খরচ হচ্ছে কত, কিছুই জানিনা আমরা। তবে নির্মাণকৃত ঘরের বরাদ্দ এক লাখ টাকা শুনেছি। আদৌ ঘর প্রতি এক লাখ টাকা খরজ হচ্ছেনা বলে জোরালোভাবেই অভিযোগ করলেন তিনি।
এরপর আমরা গেলাম একই গ্রামের প্রতিবন্ধি মহিউদ্দীনের বাড়িতে। সেও একটি এক লাখ টাকার ঘর পেয়েছে। বাস বাগানের মধ্যে সেখানেও কয়েকটি প্লিয়ার বসিয়ে আংশিক টিন লাগানো আছে। ভিত নাই, মাটিও ফেলা হয়নি। পঙ্গু মহিউদ্দীন গনমাধ্যমকর্মীদের দেখে আস্তে আস্তে দুই লাঠির উপর ভর করে আসলেন। বললেন কয়েকদিন আগে এই কাজ করে গেছে। আর মিস্ত্রি আসেনি। টয়লেটের প্লিয়ার এখনও মাটিতে পড়ে আছে। কবে কাজ শেষ হবে তা তিনি বলতে পারেন না। তিনি বলেন, যে ভাবে ঘর হচ্ছে তাতে এই ঘর হলে এক লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা নয়।
এসব বিষয়ে কথা হয় গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের সদস্য সচিব সুলতানা জাহান এর সাথে। তিনি বলেন, লোক মুখে শুনেছি কলারোয়া উপজেলায় এক লাখ টাকার করে ৬০টি ঘরের বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু আমি এব্যাপারে কিছুই জানিনা।
উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, জমি আছে বাড়ি নাই এই প্রকল্পের ৬০ ঘর এসেছে এটা শুনেছেন উপজেলার এই জনপ্রতিনিধি। তিনি বলেন, শুনেছেন ৬টি ঘর বাকি আছে এরই মধ্যে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। উক্ত ঘরের চাবিও বাড়ির মালিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রকৃতার্থে এখনও অনেক ঘর অসম্পন্ন এবং অত্যন্ত নিন্মমানের দাবী করে তিনি বলেন, বর্তমানে শেখ হাসিনার সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই প্রকল্প তৈরি করেছেন কিন্তু যারা দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করেছেন তারা সরকারকে প্রতারিত করেছেন। তিনি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিকার দাবী করেন। তিনি এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবী জানান।
তবে কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর এম সেলিম শাহ নেওয়াজ উক্ত প্রকল্পের কাজে কোন ধরণের অনিয়ম হয়নি দাবী করে বলেন, কমিটির সবাই বিষয়টি যানে। এখন অস্বীকার করলে কিছুই করার নেই। কাজ শেষ হয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, কিছু কাজ বাকি আছে সেটি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিল উত্তোলনের বিষয়ে তিনি মোবাইলে শত ভাগ উত্তোলনের কথা স্বীকার করলেও পরে ক্যামেরায় অস্বীকার করেন।
সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জানান, কলারোয়ার ইউএনও’র বিষয় নিয়ে আমি শুনেছি। বিষয়টি প্রাথমিকভাবে খোঁজ খবরও নিয়েছি। বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান সার্বিক বিষয়ে বলেছেন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে বিষয়টিতে হাত দিতে পারছি না। তবে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ১২ টি ইউনিয়নে ৬০ জনকে ৬০টি ঘর নির্মাণের লক্ষে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। গত বছরের ৩০ জুনের মধ্যে এসব ঘর তৈরির কাজ সমাপ্ত’র কথা থাকলেও ঘর নির্মাণ শেষ হয়নি। অথচ ৫সদস্যের ৪জনকে না জানিয়ে পূর্ণাঙ্গ বিল উত্তোলন করায় চলছে চরম অসন্তোস। সম্প্রতি ইউএনও আরএম সেলিম শাহ নেওয়াজ বাগেরহাট জেলার কচুয়ায় বদলির খবর আসলে গোপনে সমুদয় বিল তুলে নিয়ে পকেটস্থ্য করেছেন অভিযোগ ভুক্তভোগিদের। এনিয়ে চলছে উপজেলার বিভিন্ন স্তরে চাপা উত্তেজনা। বাড়ছে ক্ষোভ। ফলে উপরোক্ত ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবী করেছেন কলারোয়া উপজেলাবাসী। আলোচিত এই ইউএনও গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে কলারোয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করায় উক্ত অনুষ্ঠান বয়কট করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এরপর তিনি ওমরা হজে¦ চলে যান। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের ম্যানেজ করে আবারো এসে যোগদান করেন।
Check Also
সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান
নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। …