স্টাফ রিপোর্টার : নভেল করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত আরও একজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও তিনজনের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪ জনে। গতকাল বুধবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)’র নিয়মত অনলাইন ব্রিফিংয়ে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে আক্রান্তদের মধ্যে এ পর্যন্ত মোট ২৬ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম তিনজনের শরীরে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে, যাদের মধ্যে দু’জন সংক্রমণ নিয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে। এর দশদিনের মাথায় বাংলাদেশে প্রথম মৃত্যুর কথা জানায় আইইডিসিআর। সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়তে থাকায় সরকার ইতোমধ্যে সারা দেশে ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকতে বলেছে, বন্ধ রাখা হয়েছে সব ধরনের যানবাহন চলাচল।
নভেল করোনা ভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক উপসর্গ জ্বর-কাশি হলেও পরে অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তখন রোগীকে ভেন্টিলেশনে রাখারও প্রয়োজন হতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করছে। ইতোমধ্যে সরকারি হাসপাতালে প্রায় ৫০০ ভেন্টিলেটর বসানোর কাজ চলছে। আমদানি পর্যায়ে রয়েছে আরও তিনশ ভেন্টিলেটর। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে ৭০০ ভেন্টিলেটর।
“ইতোমধ্যে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকে (কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য) প্রস্তুত করা হয়েছে, সেখানে ভেন্টিলেটরও থাকবে। গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালকে প্রস্তুত করেছি, সেখানেও ভেন্টিলেটর থাকবে। বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল আগে থেকেই কাজ চলছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আরও হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে।”
মন্ত্রী জানান, করোনা ভাইরাস পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরের বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদালয়, মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ) ও শিশু হাসপতালে ‘টেস্টিং ফেসিলিট ‘ চালু করা হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেলেও চালু হয়ে যাবে।
ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেস্টিং ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা হবে।
“শুধু টেস্টিং ফ্যাসিলিটি থাকলে চলবে না। জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। জনগণ এগিয়ে আসুক, টেস্ট করুক। আমি চাচ্ছি না কোনো জনগণ টেস্টের বাইরে থাক। যারা সন্দেহজনক অবস্থায় আছেন, তারা টেস্ট করুন, নিজেরা ভালো থাকুন এবং পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন। বেশি বেশি টেস্ট করুন, নিজেকে সুরক্ষা করুন এবং সমাজকে নিরাপদে রাখুন।”
সবাইকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি পুরান ঢাকায় কিংবা ঢাকার কিছু কিছু এলাকায়, ঢাকার আশেপাশে, ইউনিয়নে, গ্রামে গঞ্জে মানুষজন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছেন, বাইরে ঘোরাফেরা করছেন, চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন। এসব করবেন না। এতে করে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে যাবে। “যারা ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে গেছেন তারা ঘোরাফেরা করছেন। আপনারা এই কাজগুলো থেকে বিরত থাকুন। আমরা এখনও ভালো আছি বলে এভাবে ঘোরাফেরা করা যাবে না, এই অবস্থা ধরে রাখতে ঘোরাফেরা বন্ধ করতে হবে।”
দেশে অনেক বেসরকারি হাসপাতালের ভালো চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে এখন সেই মাত্রায় সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “বেসরকারি ডাক্তাররা অনেকেই ভালো সেবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাদের চেম্বারগুলো এখন বন্ধ রয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর আসছে। হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা একটু স্তিমিত হয়ে গেছে। আমি আশা করব আপনারা এগিয়ে আসবেন, দেশবাসীর পাশে থাকবেন।
এদিকে জ্বর কাশি ও শ্বাস কষ্ট নিয়ে রাজধানী ঢাকা, শরীয়তপুর, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি ও নড়াইলে করোনা সন্দেহে অন্তত ৭ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার সকালে ও মঙ্গলবার রাতে এদের মৃত্যু হয়। ঢাকায় শ্বাসকষ্টসহ নভেল করোনা ভাইরাসের মতো লক্ষণ নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ষাটোর্ধ্ব ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয় বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “একজন বৃদ্ধ মারা গেছেন। তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার নমুনা নেয়ার জন্য আইইডিসিআরকে বলা হয়েছে।” নভেল করোনা ভাইরাসের উপসর্গ থাকায় তাকে আইসোলেশন ইউনিটে পাঠানো হয়।” রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একজন রোগী মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তিটি পুরুষ। বয়স পঞ্চাশের ঘরে। হাসপাতালের পরিচালক উত্তম বড়ুয়া তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। মঙ্গলবার দুপুরেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করা হয়। সন্ধ্যার দিকে তিনি মারা যান।
উত্তম বড়ুয়া বলেন, ওই রোগী প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। কুর্মিটোলা ওই রোগীকে সোহরাওয়ার্দীতে পাঠিয়ে দেয়।
শরীয়তপুর: শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে আইসোলেশনে ভর্তি থাকা ৩৪ বছরের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ওই যুবকের বাড়ি নড়িয়া উপজেলায়। তিনি পেশায় শ্রমিক ছিলেন। মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও কাশি থাকায় ওই যুবককে মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) সন্ধ্যায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। এর আগে ১৯ মার্চ কাশি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। পরীক্ষায় তার যক্ষ্মা ধরা পড়ায় তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসা শেষে ২৩ মার্চ তিনি সদর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে যান।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মুনির আহমেদ খান বলেন, তিনি নড়িয়া এলাকার বাসিন্দা। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসেন। শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল তার। শ্বাসকষ্ট থাকায় তাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। চিকিৎসা দেয়া অবস্থায় তিনি মারা যান।
রাজশাহী: জ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত এক যুবক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
হাসপাতালের করোনা ভাইরাস রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্থাপিত আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। তবে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওই যুবক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নন। তিনি হাঁপানির রোগী ছিলেন। মৃত ওই যুবকের বাড়ি নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার নবীনগর গ্রামে।
হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে যুবককে হাসপাতালের করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। ‘জ্বর ও শ্বাসকষ্ট’ থাকার কারণে হাসপাতালের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
নড়াইল: জ্বর-শ্বাসকষ্ট আর বমি নিয়ে নড়াইল সদর হাসপাতালে আসার পর এক তরুণ মারা গেছেন। ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তৌহিদুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে ওই রোগীকে তাদের হাসপাতালে আনা হয়। তার শ্বাসকষ্ট ও বমি হচ্ছিল। জ্বর ছিল না। জরুরি বিভাগ থেকে চিকিৎসা দিয়ে ওয়ার্ডে পাঠানোর পরপরই তিনি মারা যান।
সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে জ্বর, সর্দি, কাশি ও হাঁচি নিয়ে এক নারী মারা গেছেন। বুধবার ভোরে কালীগঞ্জ উপজেলার বন্দকাটি গ্রামে বাবার বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে মনে করছে। ওই নারীর নাম রাশিদা খাতুন (২৫)। তিনি কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর গ্রামের ফতেপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ও পাশের বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বন্দকাটি গ্রামের আবদুস ছালামের মেয়ে।
চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে ৭০ বছর বয়সী একজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে পোমরা ইউনিয়নের নিজ বাড়িতে তিনি মারা যান। পরিবার বলছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন। কয়েক বছর ধরে তার শ্বাসকষ্ট ছিল। মঙ্গলবার বিকেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় তাকে বাড়িতে নেবুলাইজ করা হয়। তার জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট থাকায় স্থানীয় চিকিৎসক তাকে চট্টগ্রাম সংক্রামকব্যাধি হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি মারা যান। মৃতের পরিবারে বিদেশ ফেরত কিংবা সংস্পর্শে যাওয়ার কোনো ইতিহাস নেই। বুধবার সকালে তাকে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রাজীব পালিত বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘ওই রোগীর বিষয়ে আমরা খবর নিয়েছি। যতটুকু জেনেছি- কয়েক বছর ধরে তার হৃদরোগ ও শ্বাসকষ্ট ছিল। তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন না বলেই ধারণা করছি। তারপরও বিষয়টি চট্টগ্রাম কন্ট্রোলরুমে জানানো হয়েছে। কারণ, স্থানীয় লোকজন করোনা সন্দেহ করে উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিল।’
উপজেলা করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুদুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার স্থানীয় এক ব্যক্তি মুঠোফোনে আমাকে জানিয়েছেন। আমি তাৎক্ষণিক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে দেখতে বলেছি। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি।’
ঝালকাঠি: ঝালকাঠিতে জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আলভী (৩) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার আমুয়া এলাকার পূর্বপাড় সরদারপাড়া গ্রামে তার মৃত্যু হয়।
আলভীর গত কয়েক দিন পর্যন্ত জ্বর, পাতলা পায়খানা ছিল। গতকাল রাতে অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের লোকজন কাঁঠালিয়া আমুয়া স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আলভী একই গ্রামের শহীদ উদ্দিন সরদারের ছেলে। এ ঘটনায় ওই বাড়ির ছয়টি পরিবারকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
Check Also
যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার
নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …