করোনায় নিহত ১৩ বছর বয়সি ইসমাইল ওয়াহাবের জানাযা (ভিডিও)

কফিনবন্দি লাশ। খুব সতর্কতার সঙ্গে নামানো হলো, যেন কারো শরীরে স্পর্শ না লাগে। তারপর জানাজা। কমপক্ষে দুই মিটার করে দূরত্বে দাঁড়িয়ে ১৫ জনের মতো মানুষ। তারা জানাজা পড়ালেন মৃত ইসমাইল মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাবের। তারপর লাশ নেয়া হলো কবরের কাছে। কেউ হাত দিয়ে কফিন ধরলেন না। কফিনের

কাছে গেলেন ৫ জন।

তার মধ্যে তিনজন সাদা পিপিই পরা। অন্যরা অন্য রঙের। দু’জন কফিনের সামনে কফিনের কাঠের নিচ দিয়ে রশি প্রবেশ করিয়ে দিলেন। অন্য দু’জন পিছন দিকে একই পদ্ধতিতে রশি লাগিয়ে দিলেন। চারজন রশির সাহায্যে কফিনটি আলগা করে তুললেন। রশির সাহায্যেই তা কবরে নামিয়ে দিলেন। এরপর শেষ করলেন দাফন অনুষ্ঠান। এতে লাশকে মোটেও হাতের স্পর্শ দিতে হয় নি। এ যেন রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও তালতলা কবরস্তানে দাফন করা মোহাম্মদপুরের সেই মৃত মায়ের দাফনের মতোই।

এই দাফন বাড়িতে বসে অনলাইনে লাইভ দেখছিলেন ইসমাইলের মা ও অন্য ৬ ভাইবোন। তারা ইসমাইলের দাফন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পর্যন্ত না পারায় হাউমাউ করে কাঁদছেন। তাদেরও করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাই কোয়ারেন্টিনে ঘরের ভিতর। এমন হৃদয়স্পর্শী ঘটনা বৃটেনের ব্রিক্সটনের।

বৃটেনে এ যাবত যত মানুষ মারা গিয়েছেন তার মধ্যে ইসমাইলই সবচেয়ে কম বয়সী। তার বয়স মাত্র ১৩ বছর। সে সোমবার একটি হাসপাতালে মারা গেছে। তাকে দাফন করা হয়েছে শুক্রবার বিকেলে। এ সময় সেখানে যেসব শোকার্ত মানুষ উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে পরস্পর থেকে দুই মিটার দূরত্বে থাকতে বাধ্য করা হয়। তারা যাতে নিরাপদ থাকেন এ জন্য দেয়া হয় নিরাপত্তামুলক পোশাক, গ্লোভস এবং মাস্ক। তারা যে পদ্ধতিতে ইসমাইলকে কবরে নামিয়ে দাফন শেষ করেছেন তা শুধু অনলাইন তার মা ও ৬ ভাইবোন প্রত্যক্ষ করেছে। দক্ষিণ লন্ডনের ব্রিক্সটনে সোমবার দিনের প্রথম ভাগে কিংস কলেজ হাসপাতালে একা একাই মরে পড়ে থাকে ইসমাইল। এরপর তাকে চিসলেহার্স্টে এটারনাল গার্ডেনস মুসলিম বারিয়াল গ্রাউন্ডে দাফন করা হয়। এতে শোকার্ত স্বজনের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তার দুই চাচা ও কাজিনরা। তাদেরকে দেয়া হয়েছিল পিপিই পোশাক। সবাইকে জানাজার সময় কমপক্ষে দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য করা হয়। জানাজা পড়ান কবরস্তানের একজন হুজুর। তারপর রশির সাহায্যে যখন ইসমাইলকে অন্ধকার মাটির প্রকোষ্ঠে নামিয়ে দেয়া হতে থাকে, তারা সেখানে দাঁড়িয়ে বুক ভরা ব্যথা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তা প্রত্যক্ষ করেন। চোখ থেকে অশ্রু ঝরে ভিজে যেতে থাকে গন্ড। আর বাড়িতে মা? ভাবুন, তার কি অবস্থা। তিনি ও তার অন্য সন্তানরা প্রিয় সন্তানের মৃতদেহটির কাছে যেতে পারলেন না। শুধু বুকফাটা আর্তনাদে আকাশবাতাস ভারি করে তুললেন। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ- এভাবে কেন মানুষের শেষ পরিণতি হচ্ছে আল্লাহ! আমাদের খারাপ কাজের জন্য লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাই। পুরো মানবজাতিকে তুমি রক্ষা করো।

বৃটেনে ভয়াবহ করোনা ভাইরাস এভাবেই একের পর এক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। এসব মৃত মানুষকে স্বজনরা পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারছেন না। প্রিয়জনের দাফন এতটা আতঙ্কিত পরিবেশে হবে এমনটা কেউ কল্পনাও করতে পারেন নিন। বলা হয়েছে, ৬০ বছরের বেশি বয়স এমন বৃটিশ নাগরিকদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তবে তরুণ, শিশু বা কিশোর বয়সীদের মধ্যেও এমন বিয়োগবিধূর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ বেশ কয়েকজন তরুণ, যুবা মারা গেছেন করোনা ভাইরাসে। এর মধ্যে রয়েছেন দু’জন নার্স। সম্প্রতি এমন বেশ কয়েকজন যুবক-যুবতী মারা গেছেন করোনা ভাইরাসে। তার মধ্যে রয়েছে ১৯ বছর বয়সী শেফ লুকা ডি নিকোলা, ৩৩ বছল বয়সী ফার্মাসিস্ট পুজা শর্মা, ২৮ বছর বয়সী পেইন্টার ও ডেকোরেটর এডাম হারকিনস সুলিভান প্রমুখ।

ইসমাইলের পিতা পাঁচ বচর আগে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে মারা গেছেন। ইসমাইলের মা সাদিয়া তার ৭ সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। কিন্তু শেষ বারের জন্য নিজ হাতে সন্তানের লাশটাও স্পর্শ করতে পারলেন না। একদিকে সন্তান হারানোর বেদনা, তার সঙ্গে সেই সন্তানের লাশ স্পর্শ করতে না পারা- এই দুই কষ্টে তিনি পাথর হয়ে গেছেন। তাকে বাধ্য করা হয়েছে অনলাইনে দাফন অনুষ্ঠান দেখতে। সে দৃশ্য বার বার দেখছিলেন আর চেতনা হারিয়ে ফেলছিলেন সাদিয়া। কি করে সহ্য করবেন এত বড় আঘাত! কোন মা পারেন তার সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে! কোন মা পারেন তার সন্তানকে শেষ বিদায়ের আগে স্পর্শ ছাড়া ছেড়ে দিতে! কোন মা পারেন এমন কঠিনকে মেনে নিতে!!

ডেইলি মেইল লিখেছে, ইসলামী রীতিতে মৃতদেহকে প্রথমে মসজিদে নেয়া হয় জানাজার জন্য। কিন্তু বর্তমানে সব মসজিদ বন্ধ। তাই ইসমাইলকে কোনো মসজিদে নেয়া হলো না। তাকে মর্গ থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হলো ওই কবরস্তানে। সেখানেই ১৫ জনের মতো মানুষ তার জানাজা পড়ালেন। তারপর লাশ নামিয়ে দিলেন কবরে। কি করে এই কষ্ট সইবেন মা সাদিয়া!!!

ইসমাইলের আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল না। শোকগ্রস্ত পরিবার তাকে অতিশয় ভদ্র ও দয়ালু মনের বালক বলে আখ্যায়িত করেছে। ইসমাইলের ছিল হৃদয়কাড়া হাসি। গত শুক্রবার তার শরীরে করোনা ভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ে। এর মাত্র তিন দিন পরেই ফুসফুস ও হার্ট কাজ না করায় সে মারা যায়। বৃটেনে জানামতে, সেই প্রথম শিশু, এই ভাইরাসের কাছে প্রাণ হারালো। ইসমাইলের পারিবারিক বন্ধু মার্ক স্টিফেনসন বলেছেন, ইসমাইলের ছোটভাই ও বড় বোনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের হাল্কা লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়েছে। মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। মার্ক স্টিফেনসন এই শোকার্ত পরিবারটির জন্য সাহায্যের একটি তহবিল গঠন করেছেন। এর নাম দিয়েছেন- গো ফান্ড মি।

ওদিকে শোকার্ত পরিবারটিকে সমবেদনা জানাতে অনেক বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন বাড়িতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদেরকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই সমবেদনা জানিয়ে তারা ফিরে গেছেন। তাদের একজন বলেছেন, এটা এই পরিবারটির জন্য একটি ট্রাজেডি। ব্রিক্সটনে সোমালি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পরিবারটি বেশ পরিচিত। আমাদের সবার জন্য এটা বেদনার যে, ইসমাইলকে মুসলিমদের যথাযথ রীতি অনুসরণ না করে দাফন করা হয়েছে। ইসমাইলের বোন চাকরি করেন মদিনা কলেজে। সেখানকার পরিচালক মার্ক স্টিফেনসন। তিনি আর্থিক সাহায্যের জন্য যে আবেদন জানিয়েছেন জনগণের কাছে তাতে কমপক্ষে ৬৭,০০০ পাউন্ড জমা পড়েছে। তাদের টার্গেট ছিল ৪,০০০ পাউন্ড। তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ সংগ্রহ হয়েছে ওই উদ্যোগ থেকে।

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।