ক্রাইমবার্তা রিপোটঃ :সাতক্ষীরা: সমন্বয়হীনতার কারণে সাতক্ষীরায় করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীনরা যথাযথ খাদ্য সহায়তা পাচ্ছে না। রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতির কারণে বেশির ভাগ ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যান গাড়িচালক, পরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদার এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে সংসার চালান তাদের তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দিয়ে ছিল স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী। জেলাতে যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে সংসার চালাতো তাদের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধীক। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় জোরপূর্বক ত্রাণ সংগ্রহ, অপরিকল্পিতভাবে ত্রাণ বিতরণ, মানুষের মধ্যে নিয়ম না মানার প্রবণতা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন সুত্রমতে জেলাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ নিন্ম আয়ের পরিবার রয়েছে। এ পর্যন্ত জেলাতে প্রায় ৪০ হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত অভাবী মানুষের কাছে ত্রাণ কম যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। করোনাভাইরাসের কারণে শহর ও গ্রামে কর্মজীবী এসবম মানুষ এখন কর্মহীন অবস্থায় আছেন। চলতি বোরো ধান না উঠা পর্যন্ত এসব পরিবারেও খাদ্য সহায়তা দেয়ার দাবী সংশ্লিষ্টদের। সূত্র বলছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। দু-তিন দিনের মধ্যে তালিকা প্রস্তুত হয়ে যাবে।
এছাড়া পৌরসভা/ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কৃষি শ্রমিকসহ উপাকারভোগীদের তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য সহায়তা প্রদান করার দরকার। স্থানীয় পর্যায়ের বিত্তশালী ব্যক্তি/এনজিও কোন খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে চাইলে জেলা প্রশাসক প্রস্তুতকৃত তালিকার সঙ্গে সমন্বয় করবেন যাতে দ্বৈততা পরিহার করা যায় এবং কোন উপকারভোগী বাদ না পড়ে। একই সঙ্গে নানান সামাজিক সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও ত্রাণ বিতরণের চিত্র বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে সরকার সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণের সুস্পষ্ট নির্দেশদানের পরও এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
স্বল্প আয়ের মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য মানুষ ও সংগঠন। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ত্রাণ বিতরণ, মানুষের মধ্যে নিয়ম না মানার প্রবণতা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দিচ্ছে। কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও তৈরি হচ্ছে। ‘ঘরে থাকা’র কর্মসূচী সফল করতে কর্মহীন ও গরিব মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে চলছে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। তবে বিভিন্ন স্থানে প্রশাসন, দলীয়, সামাজিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ বিতরণে বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক দূরত্ব না মানার চিত্রও ফুটে উঠছে। ত্রাণ বিতরণে সামাজিক দূরত্ব (অন্তত তিন ফুট দূরত্ব রেখে অবস্থান করা) না মানায় করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছে। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় ও নিয়মিত তদারকি দরকার। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ বিতরণের মানচিত্র তৈরি করাও জরুরী।
সূত্র জানায়, করোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রাথমিক ভাবে জেলার ৩১ হাজার ৫শটি পরিবারকে সহায়তার জন্য সরকারের দূর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়েরর প্রাপ্ত বরাদ্দ থেকে ৩১৫ মেট্রিক টন চাল ও ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরসভার মেয়রগণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে তালিকা করে এই ত্রাণ সহায়তা কর্মহীন হয়ে পড়া দুস্থ অসহায় মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন। এছাড়া জেলা পুলিশ ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের উদ্যোগে সাড়ে ৮ হাজার পরিবারের মাঝে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৪৩ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫শ টাকা, কলারোয়া উপজেলায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তালা উপজেলায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আশাশুনি উপজেলায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, দেবহাটা উপজেলায় ৩২ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা, কালিগঞ্জ উপজেলায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫শ টাকা, শ্যামনগর উপজেলায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সাতক্ষীরা পৌরসভায় ৩৭ মেট্রিক টন চাল ও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং কলারোয়া পৌরসভায় ১৮ মেট্রিক টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরা পৌরসভার নিজস্ব ফান্ড থেকে আরো ৭লক্ষ টাকার অনুদান প্রদান করা হচ্ছে।
গত ২৯ মার্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরির জন্য সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে সংকোচ বোধ করেন, তাঁদের জন্যও তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এত অল্প সময়ে একাধিক তালিকা করা কতটা সম্ভব তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সরকারী কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারিভাবে যাঁরা ত্রাণ দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই কথা শুনছেন না। বিশেষ করে স্থানীয় সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ করছে।
যায়যায় দিন পত্রিকার সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি জানান, আতœীয়-স্বজন এবং অফিসের লিয়াজো লোকদের তালিকা অনুযায়ী অর্থসহায়তা বেশি করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার বার্তা সম্পাদক শহিদুল ইসলাম তার ফেসবুক স্ট্যার্টাসএ বলেন,“অনেক জায়গাতে দাতার চেয়ে গ্রহিতার সংখ্যা কম। আবার দাতার দানের চাপ সামলাতে গ্রহিতার চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। এভাবে চলতে থাকলে দাতারাই একদিন বাড়ি বাড়ি করোনা পৌঁছে দিবে নাতো? ত্রাণ বিতরণে কোনো সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না। যে যার মতো বিতরণ করছেন। কেউ কেউ দুই কেজি চাল নিয়ে ২০০/৩০০ পরিবারের দায়িত্ব নিচ্ছেন আর ৫/৬ জনের ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছেন। দান করবেন, ভালো কথা। কিন্তু এভাবে কেন? সরকারি নির্দেশনা মেনে এই মুহূর্তে যারা ঘরে আছেন তারা আপাতত সুরক্ষিত। কিন্তু তাদের বাড়িতে দল বেঁধে গিয়ে ‘কথিত ত্রাণ বিতরণকারী’ দাতাগণ সুরক্ষিত আছেন তো??? একই চিত্র মাস্ক লিফলেট বিতরণেও।”
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল লাইভ অনুষ্ঠানে জানান,স্বজনপ্রীতি ও র্নিবাচন প্রীতির উর্ধ্বে এসে ত্রাণ বিতরণ করতে সবার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘সমন্বিতভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি। বেসরকারি ত্রাণ বিতরণে কেউ কেউ আমাদের কাছে আসছেন, তাঁদের প্রয়োজনীয় জায়গায় ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর বিষয়ে সহায়তা করা হচ্ছে। তার পরও যদি কেউ বাদ পড়েন বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বলতে লজ্জা বোধ করেন, তাঁরা আমাদের ফোনে বা ফেসবুকে তথ্য দিলে বাড়িতে ত্রাণ পৌঁছে দেব।’