নূহ আ.-এর মহাপ্লাবন প্রেক্ষাপট আজকের করোনাভাইরাস

একেএম রফিকুন্নবী : ক্রাইমর্বাতাবাতা রিপোট:  দুনিয়াব্যাপী আজ করোনাভাইরাস নামের একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর গ্রাসে পর্যুদস্ত। এ রকম অদৃশ্যমান এ জীবাণু ছোট-বড়, রাজা-প্রজা, সাদা-কালো এক আল্লাহপাকে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাইকে তাঁর শাস্তির আওতায় এনে পরীক্ষা করছেন। আমাদেরকে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে এবং দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে মানবজাতিকে এক আল্লাহর পথে আসার ডাক দিতে হবে এবং আখিরাতে জান্নাতুল ফেরদাউস পাওয়ার পথ দেখাতে হবে।প্রয়োজন একজন ঈমানদার, সাহসী এবং দায়ী ইল্লাহর সিপাহসালার। প্রয়োজন একজন ‘জুলকারনাইন’। প্রয়োজন একজন আল্লাহর পথে ডাকার ‘রাহবার’।বর্তমান দুনিয়ার ৭শত কোটি মানুষের দুর্দশার আলোচনা করার পূর্বে মহান আল্লাহর নবী নূহ আ.-এর মহাপ্লাবন সম্পর্কে কিছু বাস্তব নমুনা তুলে ধরতে চাই।দুনিয়া সৃষ্টির সাথে সাথেই আল্লাহ প্রথম নবী আদম আ. ও বিবি হাওয়াকে তৈরি করে মানুষের চলার উপযোগী জীবনবিধান দিয়েছিলেন। বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের মাধ্যমে যুগে যুগে আরো নবী এবং রাসূল প্রেরণ করে সৃষ্টির সেরা মানুষকে এক আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং যুগে যুগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তার অনুগত বান্দাদের বাছাই করার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।তেমনি ঘটনা হযরত নূহ আ.-এর সময়ের ‘মহাপ্লাবন।’ নবীযুগের প্রথম দিকের ঘটনা। নূহ আ.- তাঁর জাতিকে এক আল্লাহর অনুগত হওয়ার জন্য দাওয়াত দেন। জনগণকে তাদের সুবিধাবলীর কথাও উল্লেখ করেন। ভালো ও মন্দের বিচার সম্পর্কে সূরা নূহ-এর ১-২৮ আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও সূরা আল ইমরানের ৩৩, আনআমের ৮৪-৯০, আল আরাফের ৫৯-৬৪, ইউনূসের ৭১-৭৩, হুদের ২৫-৪৮, ইব্রাহীমের ৯-১৭, বনী ইসরাইলের ৩, আম্বিয়ার ৭৬-৭৭, মু’মিনূনের ২৩-২৯, আল ফুরকানের-৩৭, শোয়ারার ১০৫-১২০, আনকাবুতের ১৪-১৫, সাফফাতের-৭৫-৮৩, আল যারিয়াতের ৪৬, আল হাদীদের ২৬, তাহরীমের ১০, আল হাক্কাহর ১১নং আয়াতে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। কলেবর বৃদ্ধি হবে বলে সব আয়াতের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো না।নূহ আ. প্রায় ৯৫০ বছর তার উম্মতদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাঁর কথা ছিল, ‘হে আমার জাতি! আমি হচ্ছি তোমাদের জন্য একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী ব্যক্তি। তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁকেই ভয় করো। তোমরা আমার আনুগত্য কর, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের গুনাহ-খাতা মাফ করে দেবেন এবং তিনি তোমাদের এক সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দেবেন। হ্যাঁ, আল্লাহর সেই নির্দিষ্ট সময় যখন এসে যাবে, তখন তাকে পিছিয়ে দেয়া যাবে না। কতো ভালো হতো যদি তোমরা বুঝতে পারতে।’ এভাবে দাওয়াত দেয়ার পরও যখন তার এলাকার জনগণ আল্লাহর দিকে মুখ ফেরাল না, তখন মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের অপরাধের জন্যই তাদেরকে (মহাপ্লাবনে) ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, (পরকালেও) তাদের জাহান্নামের কঠিন আগুনে প্রবেশ করানো হবে। এ অবস্থায় তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেই সাহায্যকারী হিসেবে পাবে না।এ মহাপ্লাবনে আল্লাহর নির্দেশে নূহ আ. বড় একটি নৌকা তৈরি করলেন। জীবজন্তু, পশুপাখি, গাছপালা অর্থাৎ দুনিয়ার প্রত্যেক প্রজাতির জোড়া জোড়া করে সব নৌকায় উঠালেন। প্লাবন শুরু হলো। তখনও অবিশ্বাসীরা পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় নেয়ার আশায় আল্লাহর নবীর নৌকায় উঠল না। এমনকি নূহ নবীর এক ছেলে ও স্ত্রীও অবিশ্বাসীদের সাথে রয়ে গেল । আল্লাহর নির্দেশই কার্যকর হলো। নূহ নবীর নৌকা ছাড়া আর কোনো কিছুই দুনিয়াতে বেঁচে থাকল না। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা নৌকায় আরোহণকারীদের জমিনে আসার সুযোগ দিলেন। শুরু হলো নবজীবনের পালা। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা নাফরমান বান্দাদের ডুবিয়ে মারলেন, আখিরাতেও তারা অগ্নিশিখার গহŸরে পতিত হবে এবং সেখানে তারা সীমাহীন জীবনে কষ্টে দিনাতিপাত করবে।মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা., শেষ নবী। আল-কুরআন শেষ পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। নবীর আহŸানে যারা চলেছে, তারা দুনিয়াতেও কামিয়াবী, আখিরাতেও জান্নাতুল ফেরদাউস পাবে। যারা আল্লাহর শেষ নবীকে মানেনি এবং আল-কুরআনের জীবনবিধান অনুসারে জীবন চালায়নি, তারা দুনিয়াতে লাঞ্ছিত হয়েছে, আখিরাতেও সীমাহীন জীবনে জাহান্নামের অতল গহŸরে নিপতিত হয়েছে।আজকের এই বিংশ শতকে দাঁড়িয়ে প্রায় ৭শত কোটি মানুষের পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তায়ালার কুরআনে বর্ণিত প্রায় সব নিয়ম-কানুনের বরখেলাপ করে পৃথিবীটাকে জলে, স্থলে, আকাশে পরিবেশ দূষণসহ মানুষে মানুষে মারামারি, হানাহানি, আল্লাহপাকে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই আল্লাহর নিয়ম ভঙ্গ করে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে মহান আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত। দেশে দেশে আল্লাহর নিয়ম বরখেলাপ করে নামাযে আযান দেয়া বন্ধ, মেয়েদের হিজাব পরা বন্ধ করা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, সুদ-ঘুষ, ব্যভিচার অনায়াসে চালু করে সরকারি প্ররোচনায় উৎসাহ দিচ্ছে। এমনকি কয়েকটি দেশে নির্লজ্জভাবে শতাব্দীর নিকৃষ্ট কাজ ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়ে বিয়ে দেয়ার এক অদ্ভুত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।মহান আল্লাহ তায়ালা শেষ নবীর উম্মতের পর তার ধৈর্যের সীমা প্রায় ১৫০০ বছর দীর্ঘায়িত করে এবার মানবজাতির ওপর একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, চোখে দেখা যায় নাÑ এমন একটি ভাইরাস দিয়ে গোটা মানবজাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছেন।এ পর্যন্ত ২০৯টি দেশে এ ভাইরাস আঘাত হেনেছে, মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ৮ এপ্রিল বুধবার পর্যন্ত মৃত্যুর পরিমাণ ৮২,০৭৩ জন।দুনিয়াতে যারা পরাশক্তির মালিক দাবিদার, তাদের এ শক্তি কোনো কাজেই আসছে না। সবাই ঘরে বসে গেছে। লকডাউনের নামে নৌপথ, স্থলপথ, আকাশপথ সবই প্রায় বন্ধ। ভয়ে, আতঙ্কে দিশেহারা গোটা মানবজাতি ও তাদের কর্তাব্যক্তিরা। ঘরে বসেই দুনিয়ার সব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র মহানবীর দেখানো পথ, পাক-পবিত্রের মাফকাঠি হাত ভালো করে ধোয়া, ঘর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, হিজাব পরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে পুরো নেকাবসহ হিজাব চালু করা, ঘরে ঘরে আযান চালুসহ দুনিয়াকে পূতঃপবিত্র করার যাবতীয় পথ ও পাথেয় অনুসরণ করার জন্য সরকারি বাহিনী, সেনাবাহিনীসহ সকল সেবামূলক সংস্থাকে দিনরাত কাজ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।ইতোমধ্যে গোটা দুনিয়ার ধনী-গরিব সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ঘরে থাকার আহŸান, কারফিউ জারি থেকে শুরু করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অহরহ মাইকিং, রাষ্ট্র, প্রচারযন্ত্র, পত্রপত্রিকা সবই এখন পাক-পবিত্র হওয়ার নসিহত ২৪ ঘণ্টা চালু রেখেছে।আমাদের জন্মভ‚মি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ৩১ দফা কার্যবিধি জারি করেছেন, এই ক্ষুদ্র ভাইরাস থেকে বাঁচার পথ হিসেবে। মহাশক্তিধর আমেরিকার প্রেসিডেন্টসহ ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং প্রাচ্যের সব দেশে একদিকে লকডাউন; অন্যদিকে পাক-পবিত্র হওয়ার জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম পুরোদমে চালু করেছেন।মুসলমানের দিনে পাঁচবার নামায পড়ার জন্য পাঁচবার অজু করা, গোসল করা, পায়খানা-প্রস্রাব করার পর পবিত্রতা অর্জন করা, আল্লাহর শেষ নবীর সময় থেকেই বাধ্যতামূলক কার্যকর আছে। পাক-পবিত্র থাকা মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গ।যারা পাক-পবিত্র হওয়ার ধার ধারে না, মাসে ২-১ বার গোসল করার প্রয়োজন মনে করে, আবার স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ব্যাপারেও পবিত্রতা বজায় রাখে না, তাদের সময় এসেছে মুসলমানদের থেকে পাক-পবিত্রতার সবক নেয়ার। আর আমি পূর্বেই বলেছি, এখনই সময় আল্লাহর বাণী দুনিয়াবাসীর কাছে পৌঁছানোর জন্য একজন ‘রাহবার’ দরকার। যিনি আল-কুরআনের শাশ্বত চিরসত্য বাণী বাস্তবতার আলোকে আল্লাহর ভাষায় তুলে ধরবেন।পবিত্র কুরআনের ভাষায়, ‘হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের (সবাইকে) সৃষ্টি করেছেন। আশা করা যায়, তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।’ ‘যিনি জমিনকে তোমাদের জন্য শয্যা বানালেন, আসমানকে বানালেন ছাদ এবং আসমান থেকে পানি পাঠালেন, তা দিয়ে তিনি নানা প্রকার ফলমূল উৎপাদন করে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করলেন এরপর জেনেবুঝে (কাউকে) আল্লাহর সমকক্ষ বানিও না।’‘আমি আমার বান্দাদের ওপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছি, তার ব্যাপারে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তবে তার মতো একটি সূরা তোমরা (রচনা করে) নিয়ে এসো। তোমাদের বন্ধু-বান্ধবকেও ডাকো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’‘তোমরা যদি তা না পারো এবং কখনোই তোমরা তা পারবে না, তাহলে (জাহান্নামের) সেই কঠিন আগুনকে ভয় করো। যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। এটা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে তাদের জন্য ,যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে।’‘যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করে, (হে নবী) তাদের সুসংবাদ দাও, তাদের জন্য রয়েছে এমন এক জান্নাতÑ যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তাদেরকে যখন (জান্নাতের) কোনো ফল দেয়া হবে, তারা বলবে এ জাতীয় ফলমূল ইতিপূর্বেও দেয়া হয়েছিল, এ ধরনের জিনিসই তাদেরকে দেয়া হবে। তাদের জন্য থাকবে পবিত্র সহধর্মী ও সহধর্মিণী এবং তারা সেখানে থাকবে চিরকাল।’ Ñসূরা বাকারা : ২১-২৫।এভাবেই মুসলমানদের এ মুহূর্তে নেতৃত্ব দিয়ে দুনিয়াবাসীকে পথ দেখাতে হবে, দুনিয়াকে আল্লাহর রঙে রঙিন করার বাস্তবতা তুলে ধরতে হবে। ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ধারণ করতে হবে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ বাদ দিয়ে দুনিয়ার সব মানুষের কল্যাণ, অগ্রগতি, মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি দূর করে আসুন আমরা গোটা দুনিয়ার সব মানুষকে কল্যাণের পথে, সত্যের পথে, জান্নাতের পথে ডাক দিই। দুনিয়াকে আবার সচল করে তুলি, পাক-পবিত্রতা আর মানুষের বসবাসের উপযোগী আল্লাহর দেয়া কুরআনের বাণীর আলোকেই পৃথিবীতে জান্নাতের পরিবেশ তৈরি করি। মহান আল্লাহ আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে দিন। আমাদের কাজের বরকত দিন। সহজ-সরল পথ দেখান, আমাদেরকে আপনার খলিফার মর্যাদা দান করুন। আমীন।লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।