ক্রাইমর্বাতা রিপোট: সাতক্ষীরা:সাতক্ষীরায় বিদেশ ফেরত আরো নতুন ১০ জনসহ মোট ৩ হাজার ৫০২ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে আরো ২ হাজার ৪১ জনকে। এছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের আসোলেশনে রয়েছে ৩ জন।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা থেকে মোট ১৭০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পৌঁছেছে। ১৬ টি রিপোর্টই নেগেটিভ এসেছে। বাকীদের রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি।
ধীরগতির পরীক্ষার কারণে সাতক্ষীরা জেলায় করোনা ভাইরাসের সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যাপ্ত পরীক্ষা ছাড়া করোনার ভয়াবহতা নিরূপণ সম্ভব হচ্ছে না। ধীরগতির পরীক্ষায় সর্বনাশ, নমুনা সংগ্রহে ত্রুটি, ল্যাবে গতিসঞ্চার কম থাকায় জেলায় করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এছাড়া আক্রান্ত এলাকা থেকে গত দুই দিনে জেলায় তিন থেকে চার হাজার লোক আগামন করেছে। প্রশাসনিক ভাবে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার দাবী করা হয়েছে। ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মাদারিপুর এবং শরিয়তপুর থেকে এসব লোকের আগমর ঘটেছে। চোরায় পথে ভারতের বোম্বে থেকেও আসার খবর মিলেছে।
এপর্যন্ত জেলাতে করোনার উপসর্গ থাকায় ১৭০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। গত ১০ দিনে মাত্র ২১ জনের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট সরবরাহ করা হয়েছে যাদের রিপোটে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েনি। অন্যদিকে নমুনা পরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছে এখনো ১৪৯ জন।
এর মধ্যে ৩ এপ্রিল ৫টি,৪ এপ্রিল ৭টি, ৫ এপ্রিল ১টি, ৬ এপ্রিল ১৫টি, ৭ এপ্রিল ৩৮টি, ৯ এপ্রিল ২৬টি, ১০এপ্রিল ৩টি, ১১এপ্রিল ২০টি,এবং ১২এপ্রিল ১৩টি, ১৩ এপ্রিল এবং ১৪ এপ্রিল ০টি সমুনা সংগ্রহ করে খুলনা ল্যাবে পাঠানো হয় বলে জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়।
গত কয়েকদিনের নমুনা পরীক্ষা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮ এপ্রিল দেশে মোট ৯৮১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়, সেখানে ৫৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। ৯ এপ্রিল ৯০৫টি নমুনা সংগ্রহ করে ১১২ জন শনাক্ত হয়। ১০ এপ্রিল ১১৮৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৯৪ জন শনাক্ত করা হয়। ১১ এপ্রিল ৯৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৫৮ জন শনাক্ত হয় এবং ১২ এপ্রিল ১৩৪০টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩৯ জন শনাক্ত হয়। এ পর্যন্ত ৯৬৫৩ জনকে পরীক্ষা করে মাত্র ৬২১ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ না করায় এ ধরনের ফল পাওয়া যাচ্ছে।
অধিকমাত্রায় পরীক্ষা না হওয়ায় করোনার ভয়াবহতা নিরূপণ করা যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশে সামাজিকভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণ শুরু হয়েছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগই জানেন না, তিনি সংক্রমিত হয়েছেন এবং অন্যকে সংক্রমিত করছেন। শুধু পরীক্ষার ফল না পাওয়াতে সাতক্ষীরা জেলার বাস্তবতা বুঝতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা।
একজন ব্যক্তির দুটি নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রে তারা একটি নমুনা সংগ্রহ করছে। নমুনা পরিবহনের জন্য ভিটিএম (ভাইরাস ট্রান্সপোর্ট মিডিয়াম) পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে না। জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায় দুটি নমুনা সংগ্রহ করছে তারা। এর মধ্যে ‘স্পুটাম’ বা কফ এবং ‘নাজাল সোয়াবাস’ বা নাকের শ্লেষ্মার নমুনা সংগ্রহ।
জার্নাল অব অ্যামেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (জেএএমএ) তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় ব্রাঙ্কোলেভোলার ল্যাভেজ’-এ (ফুসফুসের ভেতর থেকে টিউবের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা)। এক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ‘স্পুটাম’ বা কফ। এক্ষেত্রে ৭২ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। এরপর যথাক্রমে ‘নাজাল সোয়াবাস’ বা নাকের শ্লেষ্মার নমুনায় ৬৩ শতাংশ, ‘ফাইব্রোঙ্কোস্কোপি ব্রাশ বায়োপসি’ বা শ্বাসনালির নিম্নানাংশের নমুনায় ৪৬ শতাংশ, গলার ভেতর থেকে নমুনা নিলে ৩২ শতাংশ, মলের নমুনায় ২৯ শতাংশ, রক্তের নমুনায় ১ শতাংশ পজিটিভ ফল পাওয়া সম্ভব। তবে মূত্রের নমুনায় করোনাভাইরাস চিহ্নিত করা যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্তে সন্দেহজনকদের ‘নাজাল সোয়াবাস’ বা নাকের শ্লেষ্মার নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নমুনায় ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার সুযোগ ৬৩ শতাংশ। তবে সেই নমুনা যদি সঠিকভাবে সংগ্রহ ও পরীক্ষার পূর্বপর্যন্ত সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে ভাইরাস চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন ডাক্তার জানান, পরীক্ষার ফল জানাতো এতো দীর্ঘ সময় লাগলে করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। গত ১০ দিনেও সাতক্ষীরায় যাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে ছিল করোনা ভাইরাসের পরীক্ষার ফল না পাওয়াতে সংশ্লিষ্ট এলাকাতে আতঙ্ক বাড়ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্টরা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার বিধি আমলে নিচ্ছে না।
তৃণমূল থেকে যাদের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে সঠিক প্রক্রিয়ায় নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে না। অনেক নমুনা বাতিল হচ্ছে। এমন মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ার একটি প্রধান কারণ হল সরকারি নির্দেশনার অভাব। যাদের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ফলে তারা ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ করতে পারছে না।
এছাড়া পিসিআর (পলিমারি চেইন রি-অ্যাকশন) ব্যবহার করে রোগ নির্ণয় একটি জটিল পদ্ধতি। এজন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন। কিন্তু খুলনা ল্যাবে দক্ষ বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে। এসব কারণে সক্ষমতা অনুসারে পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
দেশে এই সংকটকালে প্রায় ১৫ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজে লাগানোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা।
সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ হুসাইন শাফায়াত জানান,করোনা ভাইরাসের উপসর্গ পেলে আমনা নমুনা সংগ্রহ করেখুলনা ল্যাবে পাঠাছি। পরীক্ষায় ধীরগতির কারণে ফল পেতে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি আরো জানান রিপোর্ট পজেটিভ অর্থাৎ করোনা ভাইরাস ধরা পড়লে ল্যাব কর্তৃপক্ষ তাকে জানিয়ে দিবেন।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল জানান, জেলার প্রতিটি উপজেলায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতামূলক অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং সহকারী কমিশনারদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং আনসারের সমন্বয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতকরন ও অভ্যিান আরো জোরদার করা হয়েছে। আইন না মানায় রবিবা জেলাতে ২৭টি অভিযানে ৫৭টি মামলায় ২,২৪,৩০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, গত ২-৩ দিনে নারায়নগঞ্জ, মাদারিপুর এবং শরিয়তপুর থেকে সেখানে ঘোষিত লক ডাউনের মধ্যেও ৩ হাজারের মত মানুষ সাতক্ষীরা জেলাতে এসেছে। এদের মধ্যে ৭৮৪ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে এবং ২০৫০ জনকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছ।