ক্রাইমর্বাতা রিপোট: দেশে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কিছুটা স্বস্তির খবর হলো দেশে এখনো করোনাভাইরাসজনিত কোভিড-১৯ মুক্ত রয়েছে দেশের ৯টি জেলা।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ৫৫টি জেলায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এখনো করোনাভাইরাস থেকে ৯ জেলা মুক্ত রয়েছে।
৯টি জেলা হচ্ছে-সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, নাটোর, মেহেরপুর, মাগুরা ঝিনাইদহ , খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
সাতক্ষীরায় বিদেশ ফেরত মোট ৩ হাজার ৫৪২ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে আরো ৩ হাজার ৩৯৬ জনকে। এছাড়া মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে আসোলেশনে রয়েছে ৫ জন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছে আরো ৭ জন।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা থেকে মোট ২১৩ জনের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৫ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে পৌঁছেছে। ৩৫ টি রিপোর্টই নেগেটিভ এসেছে।
দিনভর ভারতে ঘোজাডাঙ্গা জিরোপয়েন্টে অপেক্ষা শেষে গত ৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় সাতক্ষীরার ভোমরা স্থল বন্দর দিয়ে দেশে আসা ১৩ বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাত্রী অবশেষে বাড়িতে ফিরলেন। তারা দীর্ঘ ১৪ দিন যুবউন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন শেষে আজ দুপুরে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস.এম মোস্তফা কামাল প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী তাদের হাতে তুলে দেন। পরে তাদের জেলা প্রশাসনের একটি মাইক্রোবাস যোগে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পৌছে দেয়া হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ বদিউজ্জামান, সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন সাফায়াত, ডাঃ জয়ন্ত সরকার ও ডাঃ সাইফুল্লাহ আল-কাফি।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন সাফায়াত বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, তাদেরকে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।
এদিকে দেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১০০ জন ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে দেশে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০১ জনে।
এছাড়া দেশে নতুন করে ৪৯২ জনের দেহে নভেল করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ এর সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়েছে। এতে দেশে এই ভাইরাসে সংক্রমিতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৯৪৮ জনে।
সোমবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানানো হয়।
করোনা প্রতিরোধে সাতক্ষীরার প্রস্তুতি কেমন?
কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের থাবায় গোটা বিশ্ব থমকে গেছে। মৃত্যুর মিছিল ভারি হচ্ছে দিনদিন। ডুকরে কাঁছে বিশ্ব মানবতা। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেও পড়েছে মহামারি করোনার ছোবল। গোটা দেশ আজ স্তব্দ। মানুষ ঘরে বন্দী। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে করোনা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। করোনা প্রতিরোধে মানুষকে ঘরে রাখতে নিরন্তর কাজ করছেন প্রশাসন, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী ও র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা। গৃহে থাকা অসহায় দুস্থ ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছেন সরকারের পাশাপাশি সমাজের দয়ালু দানশীল ব্যক্তিবর্গ। মহামারি প্রাণঘাতক করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চলছে সতর্কতামূলক অবিরাম প্রচারাভিযান। দেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, কৃষি বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী, র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচি। ইতোমধ্যে জেলার ২২ লক্ষ মানুষকে সুস্থ্য রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এসব বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। জনপ্রতিনিধিগণ মাঠে থেকে জনসচেতনতার পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণে কাজ করছেন।
সাতক্ষীরায় কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাস সংক্রমন ঠেকাতে এবং সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি কেমন তা জানিয়ে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র সংখ্যা ৮টি এবং বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র ২৪ টি। জেলায় মোট বেড ৬৩১টি এবং বেসরকারি ৪২০টি, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রস্তুতকৃত বেড সরকারি ৫৪টি, বেসরকারি বেড প্রস্তুত নেই। জেলায় ডাক্তার সংখ্যা ১২৩ জন সরকারি এবং ১৩০জন বেসরকারি। নার্সের সংখ্যা ২৮৯ জন সরকারি এবং ২৪০ জন বেসরকারি। এছাড়া ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী সরকারি ১৯৪৪টি এবং বেসরকারি নেই। পিপিই মজুদ রয়েছে ১০৪৭টি। তিনি আরও জানান, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যাক্তির চিকিৎসায় এ্যাম্বুলেন্স রয়েছে ৩ টি।
এদিকে গত ৪-৫ দিনে নারায়নগঞ্জ, মাদারিপুর এবং শরিয়তপুর থেকে সেখানে ঘোষিত লক ডাউনের মধ্যেও ১২ হাজারের মতো মানুষ সাতক্ষীরা জেলায় এসেছে। এদের মধ্যে ৩১২৪ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে এবং ৮৬১১ জনকে বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২৫ জন, শ্যামনগর উপজেলায় ১০৮ জন, কালীগঞ্জ উপজেলায় ১৬৩৩ জন এবং আশশুনি উপজেলায় ২৫ জন, দেবহাটা উপজেলায় ৩৩৩ জন, তালা উপজেলায় ১০০০ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন বলে জানান জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল।
সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা থেকে করোনা টেস্টের জন্য এ পর্যন্ত ২১২ জনের নমুনা পাঠানো হয়েছে। ২৮ জনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে। আশার কথা হলো সবাই করোনা নেগেটিভ।
এদিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় দুটি আশ্রায়ন কেন্দ্রে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যগণ ত্রাণ বিতরণ করছেন মাছখোলা ও ব্রহ্মরাজপুর বাজারকে স্থানান্তর করা হয়েছে। তালা ২৫টি বাজার স্থানান্তর করা হয়েছে। ১টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু হয়েছে। সোমবার ইউনিয়নওয়ারী ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হবে। কলারোয়া ৭টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হয়েছে।
কালিগঞ্জে ভ্রাম্যমান বাজার চালু করা হয়েছে। ফেসবুক ভিত্তিক অনলাইন ফিস মার্কেট এবং অনলাইন মার্কেট চালু করা হয়েছে। আশাশুনি ৪টি ইউনিয়নে ১৬ টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হয়েছে। শ্যামনগর ৭ টি বাজার স্থানান্তর করা হয়েছে। ১১ টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হয়েছে। দেবহাটা ৭ টি বাজার স্থানান্তর করা হয়েছে। ২ টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হয়েছে।
ভোমরা বন্দরে ২টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু করা হয়েছে। আরও ২ টি ভ্রাম্যমাণ বাজার চালু হবে। সাতক্ষীরা পৌরসভা সুলতানপুর বড় বাজারকে পিটিআই মাঠে স্থানান্তর করা হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যারা ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ে তালিকাভুক্ত হতে সংকোচবোধ করছে কিন্তু খাদ্য সংকট আছেন এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বারসহ এসএমএস এর মাধ্যমে সংগ্রহ করে এখন পর্যন্ত ৫৭৭ পরিবারের মাঝে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবার ছাড়াও অনেকে অতিরিক্ত এসএমএসও ফোন দিচ্ছেন। সেকারণে এসএমএসএর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমটি বন্ধ রাখা হয়েছে। জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেছেন, জেলা প্রশাসকের মোবাইলে যারা মেসেজ করেছেন তাদের তালিকা সংশ্লিষ্ট মেয়র, উপজেলা নিবার্হী অফিসারের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। আপনারা যারা এখনো সহযোগিতা পাননি তারা খুব শীঘ্রই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়ে যাবেন।
প্রতিটি উপজেলায় ইউনিয়ন ভিত্তিক দুস্থ ও সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে থাকা গরীব মানুষের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌছে দেয়া হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের ক্ষেত্রে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণের ব্যাগে জেলার শাক সবজি দিতে সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় থেকে পাওয়া মোট বরাদ্দ থেকে ইতোমধ্যে উপজেলা, পৌরসভার অনুকূলে ৯০০ মে. টন চাল এবং ৪৪.৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পৌরসভার মেয়রগণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করে এই ত্রাণ সহায়তা কর্মহীন হয়ে পড়া দুস্থ অসহায় মানুষের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে উপজেলা ও পৌরসভার ৭১৩০০ পরিবারের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। সকল সরকারি ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে সকলকে ব্যাগের গায়ে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’ কথাটি লিখে দেয়া হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলায় বরাদ্দকৃত ত্রাণ সহায়তা উপজেলা ও পৌরসভাওয়ারী বন্টন করে দেয়া হয়েছে। সাতক্ষিরা সদর উপজেলায় ১৩৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৬,০৩,৫০০ টাকা, কলারোয়া উপজেলায় ৯২ মেট্রিকটনচাল ও নগদ ৪,৩০,০০০ টাকা, তালা উপজেলায় ১০৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪,৭৪,০০০ টাকা, আশাশুনি উপজেলায় ৯৭ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪,৮৪,০০০ টাকা, দেবহাটা উপজেলায় ৬৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৩,৩৭,০০০ টাকা, কালিগঞ্জ উপজেলায় ৯৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪,৬১,৫০০ টাকা, শ্যামনগর উপজেলায় ১১৬ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫,৩৫,০০০ টাকা, সাতক্ষীরা পৌরসভা ১০৮ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৪,৯৭,০০০ টাকা এবং কলারোয়া পৌরসভা ৩৪ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১,২৮,০০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জেলা পুলিশও নিজস্ব অর্থায়নে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। পুলিশের ঘোষণা অনুযায়ী যারা ত্রাণ চেয়ে নিতে পারেন না তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। জেলা পুলিশের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে আবেদন জানালে পুলিশের এই ত্রাণ বাড়িতে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মোহম্মাদ মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে গত বৃহস্পতিবার আলাপকালে তিনি মধ্যবিত্ত নি¤œমধ্যবিত্ত ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের পক্ষ থেকে পাঁচ সহ¯্রাধিক আবেদন পাওয়া গেছে। ঐদিন পর্যন্ত দুই হাজারের অধিক পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌছে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি ত্রাণের তালিকা এবং বিতরণে অনিয়ম স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করা হবে। এছাড়া, দোকান খুলে দেয়ার কথা বলে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী দোকানদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঘরে থাকুন, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন, নিরাপদে থাকুন। আপনি ঘরে থাকলে ভালো থাকবে আপনার পরিবার, ভালো থাকবে জাতি, ভালো থাকবে দেশ। জনস্বার্থে সকল কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।