ক্রাইমর্বাতা রিপোট: দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে দেশে গতকাল মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গেছে।
গতকাল সোমবার নতুন করে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে করোনায় ১০১ জনের মৃত্যু হলো। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৪৯২ জনের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এক দিনে এটিই আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৯৪৮ জনে পৌঁছাল।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। ১৫ এপ্রিল ৪ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা ৫০ জনে পৌঁছায়। পাঁচ দিনের মাথায় মৃতের সংখ্যা ১০১ জনে পৌঁছাল। অর্থাৎ প্রথম মৃত্যুর পর ২৮ দিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ জনে দাঁড়ায়। আর গত পাঁচ দিনে ৫১ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী, গত রোববার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৫৩ জেলায় প্রাণঘাতী এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এখনও ১১টি জেলা সংক্রমণের বাইরে রয়েছে। তবে সোমবারের তথ্য রাত ৯টা পর্যন্ত হালনাগাদ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তথ্য হালনাগাদ হলে আরও কয়টি জেলায় নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়েছে তা জানা যাবে। এদিকে ৫৬ জেলা লকডাউন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৮ জেলা পুরোপুরি ও ১৭ জেলা আংশিক লকডাউন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, করোনা সংক্রমণের শুরুতে রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সর্বোচ্চ আক্রান্ত শনাক্ত হয়। এই দুই অঞ্চলে কয়েকটি ক্লাস্টারও পাওয়া যায়। আইইডিসিআর শুরু থেকেই বলে আসছে, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে ভাইরাসটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুর, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ- এই তিন জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এই তিন জেলাকে সংক্রমণের নতুন রুট হিসেবে দেখা হচ্ছে। নতুন করে আক্রান্তদের ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ গাজীপুরে। এরপর কিশোরগঞ্জে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং নরসিংদীতে ৬ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে ভুল ও বিলম্ব দুটিই করেছে। ভুলটি হলো আইইডিসিআর রোগতাত্ত্বিক কোনো সার্ভিলেন্স করছে না। এমনকি সঠিকভাবে কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটিও হচ্ছে না। এতে করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি অনুধাবণ করা যাচ্ছে না। আর সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করা হচ্ছে পদে পদে। দেশের মধ্যে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদীতে সংক্রমণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এই পাঁচটি অঞ্চলে কারফিউ জারি করে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। এরপর সমস্ত জনবল নিযুক্ত করে এ এলাকাগুলোতে বসবাসকারী সব মানুষের পরীক্ষা করতে হবে। এই ভাইরাসটি প্রতিরোধের মূল উপায়ই হলো টেস্ট। এর মানে হলো- পজিটিভ কেসগুলোকে আইসোলেশনে নেওয়া এবং কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে অন্যদের পৃথক করা। দ্রুততার সঙ্গে এই কাজটি করা গেলে সংক্রমণ হয়তো সামাল দেওয়া যাবে। অন্যথায় সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
মৃত্যু ১০০ ছাড়াল
প্রথম করোনার সংক্রমণ : দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ওই দিন তিন জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
প্রথম মৃত্যু : প্রথম সংক্রমণের ১০ দিনের মাথায় দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু ঘটনা ঘটে। গত ১৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমিত প্রথম এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ৭০ বছরের বেশি বয়সী ওই ব্যক্তির বিদেশফেরত একজনের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন। একই দিন নতুন করে আরও ৪ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
মৃত্যু বেড়ে ২ : ২১ মার্চ করোনাভাইরাসে দেশে দ্বিতীয় ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ৭০ বছরের বেশি বয়সী ওই ব্যক্তি বিদেশফেরত এক স্বজনের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন। ওই দিন নতুন করে আরও চারজনের শরীরে সংক্রমণ পাওয়া যায়।
মৃত্যু বেড়ে ৩ : ২৩ মার্চ করোনাভাইরাস আক্রান্ত আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ৩ জনে পৌঁছায়। ওইদিন নতুন করে আরও ৬ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তদের সংখ্যা ৩৩ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৪ : ২৪ মার্চ আরও একজনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪ জনে পৌঁছায়। একই সঙ্গে ওইদিন নতুন করে আরও ৬ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯ জনে পৌঁছায়।
মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ : ২৫ মার্চ আরও একজনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা ৫ জনে পৌঁছায়। তবে ওইদিন নতুন করে কারও শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি।
মৃত্যু বেড়ে ৬ : ১ এপ্রিল আরও একজনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা ৬ জনে পৌঁছায়। ওই দিন নতুন করে আরও ৩ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৮ জন : ৪ এপ্রিল আরও ২ জনের মৃত্যু হয়। মৃতের সংখ্যা ৮ জনে পৌঁছায়। ওই দিন আরও ৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৯ : ৫ এপ্রিল আরও একজনের মৃত্যু হয়। ওই দিন ১৮ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তের সংখ্যা ৮৮ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ১২ : গত ৬ এপ্রিল আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে ৩৫ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আক্রান্তের সংখ্যা ১২৩ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ১৭ : গত ৭ এপ্রিল ৫ জনের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হন ৪১ জন। মোট আক্রান্ত ১৬৪ জন।
মৃত্যু বেড়ে ২০ : ৮ এপ্রিল ৩ জনের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত হন ৫৪ জন। মোট আক্রান্ত ২১৮ জন।
মৃত্যু বেড়ে ২১ : ৯ এপ্রিল একজনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ২১। ওইদিন আরও ১১২ জন আক্রান্ত হন। মোট আক্রান্ত ৩৩০।
মৃত্যু বেড়ে ২৭ : ১০ এপ্রিল ৬ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ২৭ জনে পৌঁছায়। আক্রান্ত হন ৯৪ জন। মোট আক্রান্ত ৪২৪ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৩০ : ১১ এপ্রিল ৩ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৩০ জনে পৌঁছায়। ওই দিন আরও ৫৮ জন আক্রান্ত হয়। মোট আক্রান্ত বেড়ে ৪৮৪ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৩৪ : ১২ এপ্রিল ৪ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৩৪ জনে পৌঁছায়। ওই দিন নতুন করে ১৩৯ আক্রান্ত হয়। মোট আক্রান্ত ৬২১ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৩৯ : ১৩ এপ্রিল ৫ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৩৯ জনে পৌঁছায়। ওই দিন নতুন করে আরও ১৮২ জন আক্রান্ত হন। মোট আক্রান্ত ৮০৩ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৪৬ : ১৪ এপ্রিল ৭ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৪৬ জনে পৌঁছায়। ওই দিন নতুন করে আরও ২০৯ জন আক্রান্ত হন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ১২ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৫০ : ১৫ এপ্রিল আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ জনের পৌঁছায়। আক্রান্ত হয় আরও ২১৯ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ২৩১ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৬০ : ১৬ এপ্রিল আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সংখ্যা ৬০ জনে পৌঁছায়। আক্রান্ত শনাক্ত হয় আরও ৩৪১ জন। মোট আক্রান্ত ১ হাজার ৫৭২ জন।
মৃত্যু বেড়ে ৭৫ : ১৭ এপ্রিল আরও ১৫ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ জনে। একই সঙ্গে নতুন করে আরও ২৬৬ জন আক্রান্ত হওয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৮৩৮ জনে পৌঁছায়।
মৃত্যু বেড়ে ৮৪ : ১৮ এপ্রিল আরও ৯ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৮৪ জন। ওই দিন আক্রান্ত হয় ৩০৬ জন। মোট আক্রান্ত ২ হাজার ১৪৪ জন।
মৃত্যু বেড়ে ৯১ : ১৯ এপ্রিল আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়। মোট মৃত্যু ৯১ জন। আক্রান্ত হয় ৩১২ জন। মোট আক্রান্ত ২ হাজার ৪৫৬ জন।
মৃত্যু বেড়ে ১০১ : ২০ এপ্রিল আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা ১০১ জনে পৌঁছাল। একই সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছে ৪৯২ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৯৪৮ জনে পৌঁছেছে।
গতকাল সোমবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ভার্চুয়াল বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে ৮৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন।
এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা সবাই একটা বিপদের মধ্যে আছি। এ জন্য আবারও বলি, আমরা যেন ঘরে থাকি। আমরা যেন মাস্ক ব্যবহার করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। না হলে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারব না।’
মৃতদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় মৃতদের মধ্যে ৮ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী। তাদের মধ্যে ৫ জন রাজধানী ঢাকার, ৪ জন নারায়ণগঞ্জ এবং একজন নরসিংদীর বাসিন্দা। চার জনের বয়স ৬০ বছরের বেশি, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে চারজন এবং দু’জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।
ডা. নাসিমা বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫৭ জনকে আইসোলেশনে নেওয়া হয়েছে। আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪০ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন ৭১৩ জন। এ ছাড়া একই সময়ে ৩০ হাজার ৮০৯ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে ২৭০ জনকে প্রতিষ্ঠানিক হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।