ক্রাইমর্বাতা রিপোট: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোববার এক টুইট বার্তা দিয়েছেন। যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে একজন জাতীয় নেতার জন্য এমন টুইট বার্তা দেয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু মোদির ওই টুইট দেখে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছেন। কেননা, মোদি তো এভাবে কথাবার্তা বলেন না! মোদি লিখেছেন, “আক্রমণের আগে কোভিড-১৯ কারও জাত, ধর্ম, গায়ের রং, বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষা বা সীমান্ত দেখে না। সুতরাং, আমাদের প্রতিক্রিয়া ও আচরণে ঐক্য ও ভাতৃত্বের প্রতিফলনই মুখ্য হওয়া উচিত।”
এই বক্তব্য আশ্চর্য্যজনক কেন?
কারণ হলো, মোদির দল বিজেপি ও তার সরকার, অনুগত মূলধারার সংবাদ মাধ্যম স্বতস্ফূর্তভাবে করোনাভাইরাসের বিস্তারের দায় মুসলিমদের ওপর চাপাতে প্রচারণা চালিয়েছে। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য, এমনকি সহিংসতাও হয়েছে। হিন্দুত্ব অনুসারীদের মাধ্যমে হোয়্যাটসঅ্যাপ বা টুইটারে মুসলিম-বিদ্বেষী বক্তব্য, বার্তা ও ভুল তথ্য ছড়াতে বিজেপি সক্রিয়ভাবে উৎসাহ জুগিয়েছে।
এসব বার্তায় অরাজনৈতিক সংগঠন তাবলিগ জামাতের সদস্যদের মধ্যে সংক্রমণ পাওয়ার দায় ২০ কোটি মুসলিমদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ভারত যখন সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন শুরু করেছিল, তখন তাবলিগ জামাত বড় এক সম্মেলন করে।
এরপর অংশগ্রহণকারী অনেকের মধ্যে করোনার উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ঘটনাকে রং মাখিয়ে উপস্থাপন করে সকল মুসলিমের ওপর করোনা বিস্তারের দায় চাপানো হচ্ছে। অথচ মুসলিমদের সিংহভাগেরই তাবলিগ জামাতের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তাবলিগ জামাতের ওই ঘটনায় সংগঠনটির নেতৃত্বের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ থেকে ভারত সরকারের আচরণ নিয়েও বহু প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তার পরও হিন্দুত্ববাদী সমর্থকরা একে পুঁজি করে সকল মুসলিমকে এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দায়ী করছে।
এসব ঘটনা বিশ্বজুড়ে বহু পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। টাইম ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে, গার্ডিয়ান, জাপান টাইমস ও আল জাজিরায় পর্যন্ত ভারতে কভিড-১৯ জনিত ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে প্রতিবেদন ও মন্তব্য প্রচারিত হয়েছে।
কয়েকদিন আগে ইন্ডিয়া টুডে টেলিভিশনের উপস্থাপক রাহুল কানওয়াল বিশ্ববিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারিকে প্রশ্ন করেন যে, ভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে তার মন্তব্য কী। এখানে জেনে রাখা ভালো, কানওয়ালের চ্যানেলই সম্প্রতি একটি ‘স্টিং অপারেশন’ প্রচার করে। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল কারণ এতে ‘মুসলিমরা কভিড ছড়াচ্ছে’ — এমন বয়ানই ফুটে উঠেছিল। আর কানওয়ালের ওই প্রশ্নের জবাবে হারারি ইতিহাস থেকে সামান্য আলোকপাত করলেও, মূলত বেশি জোর দিয়েছেন ভারতজুড়ে মুসলিম-বিরোধী সেন্টিমেন্টের ওপর। তিনি বলেন, “আমি শুনেছি যে কিছু মানুষ এই রোগের প্রাদুর্ভাগ ও বিস্তারের জন্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের দায়ী করছেন। এমনও বলা হচ্ছে যে, এটি উদ্দেশ্যমূলক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড! এই ধরণের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমাদের আরও বিদ্বেষের প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন সংহতি। আমাদের প্রয়োজন মানুষে মানুষে ভালোবাসা।”
শুধু তাই নয়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন থেকেও নিন্দা এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, কভিড-১৯ রোগের বিস্তারের জন্য মুসলিমদের দায়ী ও লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। গুজরাটের এক হাসপাতালে মুসলিমদের আলাদা করে রাখা হচ্ছে, এমন একটি সংবাদকে উদ্ধৃতিও করেছে সংস্থাটি।
অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি) থেকেও একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, “রাজনৈতিক ও মিডিয়া সার্কেল এবং মূলধারার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত মুসলিম-বিদ্বেষী মনোভাব ও ইসলাম-বিদ্বেষ নিয়ে ওআইসি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এসব মাধ্যমে ভারতীয় মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।”
অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উভয় বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একমাত্র মুসলিম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নাকভিকে দিয়ে বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ভারত হলো মুসলিমদের জন্য স্বর্গ! অথচ, মাত্র ২ মাস আগেই মুসলিমদের প্রতি বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন পাস হওয়ার পর হাজার হাজার প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় নামলে, ধর্মীয় দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়েছিল খোদ দেশের রাজধানী দিল্লিতে।
ভারত সরকার থেকে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করা হলেও, শাসক দল বিজেপির বহু সমর্থক প্রকাশ্যেই যে ইসলামবিদ্বেষ দেখিয়ে যাচ্ছেন, তা থেকে সারাবিশ্বে মানুষের মধ্যে এই ধারণাই পোক্ত হচ্ছে যে, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত বিদ্বেষসূচক বক্তব্য ও বৈষম্যই জিইয়ে রাখছে।
গত কয়েক সপ্তাহে বিশেষ করে আরব উপসাগরীয় দেশগুলোতে এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এসব দেশে প্রায় ৭০ লাখ ভারতীয় নাগরিক কাজ করেন। অনলাইনে ইসলাম-বিদ্বেষী মন্তব্যের জন্য অন্তত ৬ ভারতীয় অভিবাসীকে বিপদে পড়তে হয়েছে। তাদের মন্তব্য কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘটেছে বেশিরভাগ ঘটনা, যেটি কিনা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক আংশীদার। সেখানে কাজ করে ৩০ লাখেরও বেশি ভারতীয় নাগরিক।
এসব ঘটনায় রীতিমত ক্যাম্পেইন আকারে উপসাগরীয় অঞ্চলে কর্মরত ভারতীয়দের মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্য খুঁজে খুঁজে বের করা হয়েছে। তবে ভারতীয় ডানপন্থীরা অবশ্য অভিযোগ করছে, এসব কাজে সহায়তা করছে পাকিস্তান।
এসবের মধ্যে বিশেষ নজর কেড়েছেন তেজস্বী সুরিয়া নামে এক বিজেপি এমপি। হিন্দুত্ব ঘরানায় জনপ্রিয় ও ষড়যন্ত্র তত্ব ও ভুল তথ্য ছড়ানোয় নাম করা পাকিস্তানি-কানাডিয়ান লেখক তারেক ফাতাহর একটি বার্তা তিনি টুইট করেছিলেন ৫ বছর আগে। সেটি ছিল অনেকটা এরকম: “৯৫ ভাগ আরব নারীরই গত কয়েকশ’ বছরে কোনো অর্গাজম হয়নি। ফলে প্রত্যেক মা-ই তাদের বাচ্চা পয়দা করেছেন যৌনতার ফসল হিসেবে, ভালোবাসার ফসল হিসেবে নয়।” এই টুইট এখন নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
কুয়েতের প্রখ্যাত অ্যাক্টিভিস্ট আব্দুর রহমান নাসের সরাসরি মোদির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ওই এমপির সদস্যপদ বাতিল করতে হবে। তার অন্যান্য টুইটেও ভারতীয়দের মুসলিম-বিরোধী আচরণের সমালোচনা করা হয়েছে।
আরব ও মুসলিম বিশ্ব যে ভারতের আয়ের অন্যতম উৎস তা-ও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে প্রতি বছর ৫৫০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স হিসেবে ভারতে যায়। সকল মুসলিম দেশ থেকে যায় ১২০০০ কোটি ডলার। এসব দেশগুলোতে ভারতীয়দের (বেশিরভাগই হিন্দু) প্রতি ভালো আচরণ করা হয়। আর বিপরীতে ভারতে মুসলিমদের সঙ্গে কী আচরণ করা হয়?”
একই ধরণের বক্তব্য দিয়েছেন কুয়েতের প্রখ্যাত আইনজীবী মেজবাল আল শারিকা। সৌদি আরবের খ্যাতনামা স্কলার আবিদি জাহরানি তার অনুসারীদের কাছে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ভারতীয়দের মধ্যে যারা মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্য করেছে, তাদের তালিকা চেয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরাই এ নিয়ে সরব হয়েছেন। আরব পার্লামেন্টারি ইনিশিয়েটিভের মহাসচিব জামাল বাহরাইন ভারতে মুসলিম নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘ ও ওআইসির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
তবে সবচেয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। শারজাহর রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্সেস হেন্দ আল কাসিমি মুসলিম-বিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘শাসক পরিবার ভারতীয়দের বন্ধু। কিন্তু রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে অনেকের রুঢ় আচরণকে মেনে নেওয়া হবে না। সকল কর্মীকেই বেতন দেওয়া হয়। কেউই বিনামূল্যে কাজ করতে আসে না। আপনারা এই দেশ থেকে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন। আর এই দেশ সম্পর্কেই আপনি বিদ্রূপ ও উপহাস করবেন, তা চোখ বুজে সহ্য করা হবে না।’
তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে যে ভারতীয়দের ব্যাপারে এমনিতেই অসন্তোষ যে নেই তা নয়। সাম্প্রতিক এক ঘটনায় এক কুয়েতি অভিনেত্রী আহ্বান জানান যে, দক্ষিণ এশিয়ার সকল অভিবাসী শ্রমিককে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হোক। তার ওই দাবিতে সমর্থন জানান আরব আমিরাতের এক সেলেব্রেটি। কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য এসব মনোভাবকে আরও উস্কে দিয়েছে। ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলের সঙ্গে দেশটির কূটনৈতিক সম্পর্কেও চিড় ধরেছে। যেমন, সংযুক্ত আমিরাতে নিযুক্ত সাবেক এক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেন যে, ভারতীয়দের এ ধরণের মানহানিকর বক্তব্য ‘এক ধরণের অপপ্রচারের আগুণে ঘি ঢালে, যা পাকিস্তানের মতো শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো ভারতের বিরুদ্ধে জনমত উস্কে দিতে ব্যবহার করে। পাশাপাশি, এসব ঘটনা সরকারের জন্যও বাড়তি কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।’
সাম্প্রতিক এসব ঘটনা যে ভারতের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সোমবারই স্পষ্ট হয়ে উঠে। মোদির ওই টুইট ছাড়াও, সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রদূত পবন কাপুরও এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “বৈষম্য আমাদের নৈতিকতা ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত ভারতীয় নাগরিকদের সবসময়ই তা মনে রাখা উচিৎ।”
(রোহান ভেঙ্কাতারামাকৃষ্ণান লিখেছেন ভারতের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম স্ক্রল.ইন-এ। সিমি পাশা লিখেছেন আরেক সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যারে।)