ঢাকাইয়া মেয়ে যখন সাতক্ষীরার বধু

মাহিনুর জাহান নিপু:  ১৯৯৮ সনে আমার বিয়ে হবার আগে পর্যন্ত আমার ভাবনায় ছিল সাতক্ষীরা মনে হয় কুমিল্লা আর চিটাগাং এর মাঝামাঝি কোন জেলা যেখানে প্রচুর ক্ষীরার চাষ হয়। আমার এ চিন্তার যে কত ভয়াবহ রকমের ভুল ছিল যখন বিয়ের কথা চলছিল আর আব্বা বল্লেন-লন্ডনে যেতে লাগে ৯ ঘন্টা আর সাতক্ষীরায় লাগে আঠারো ঘন্টা–। তখন বুঝলাম। অতএব মেয়ের বিয়ে সেখানে দেবেন না। বরের সাথে আমার আগেই পরিচয় থাকলেও সে এতই স্বল্পভাষী যে এ বিষয়ে কোন কথাও হয়নি। আব্বার আপত্তির মুখে আমার বর জানালেন (তখনো হয়নি)অসুবিধা নেই। সেতো ঢাকাতেই থাকবে। মাঝেমধ্যে সাতক্ষীরায় যাবে।
অবশেষে ব্যাপারটা ঘটেই গেল ৯৮ এর ৭ ই মার্চ এক ঐতিহাসিক দিনে। তারও প্রায় একবছর পরে ১৯ শে ফেব্রুয়ারিতে আমার ১ম সাতক্ষীরায় যাবার সুযোগ হলো পুরাপুরি বউ হয়ে। আমি সেইদিনের কথা জীবনেও ভুলবোনা। বিকেল চারটায় নরসিংদী থেকে গাড়ী ছাড়লো আর পরেরদিন দুপুর ১২টায় গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছি। এত কষ্ট হচ্ছিল।প্রত্যন্ত অঞ্চলে তখন তাদের বাড়ী। ভয়াবহ অবস্থা।
গাড়ী থেকে নেমেই নৌকা নিতে হলো।নৌকা থেকে নেমে ভ্যান এ চড়া। ভাবতেও পারিনি আমার কপালে এই ছিল।নতুন বউ লাল টুকটুকে শাড়ী আর গয়না পড়ে ভ্যানে করে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, যে নাকি এর আগে জীবনে ভ্যান দেখবে কি নামই শুনিনি।
পরদিন ছিল আমার বৌভাত। কত-শত লোক যে দলবেঁধে আসছিল ঢাকার বউ দেখতে। আমি অবাক হচ্ছিলাম তারা প্রায় সবাই নাকফুল নিয়ে আসছিল, আবার কেউ কেউ আংটি।যদিও আমার নাক ফোড়ানো তখন ছিল না। বিয়ের নাক ফুলতো বিয়ের রাতেই হারিয়ে ফেলেছি। আর তারপরদিন আমাকে একা রেখে সফি (আমার বরের নাম) সহ আমার ভাই-বোন, দুলাভাই সবাই চলে আসবে।(সফির তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েনিং ছিল)আমি বললাম আমি আপনার পায়ে পড়ি আমাকে সাথে করে নিয়ে যান।
আমি এদের ভাষা কিছু বুঝিনা।কিছুই খেতে পারিনা। এরা রান্না করে পুকুরের পানি দিয়ে।পুরা শরতচন্দ্রের কালে এসে পরেছি। সে আমাকে না নিয়েই চলে এলো ঢাকায়। বলে কি-না এখন চলে গেলে মানুষ কি বলবে? আমাকে থাকতেই হলো একসপ্তাহ। আর সেই পুরো একসপ্তাহ আমি শুধু ডাব খেয়ে থেকেছি। ওদের খাওয়াতে তখন অভ্যস্ত ছিলাম না।
তারা হাসের মাংসের পাগল আর আমার অবস্থা তখন ওয়াক থুঃ। তাছাড়া কেওড়া ফলের খাটা খেতে প্রথমে তো অবাক হয়েছি। এ আবার কিসের ডাল গো। আমার তখনকার সার্বক্ষণিক সংগী ছিল আমার বন্ধুর মতো ননদ লুছি।এখনো এভাবেই পাশে আছে আলহামদুলিল্লাহ। আর সফিকে মনে হচ্ছিল পরম শত্রু। মনে মনে ভেবেছিলাম একবার ঢাকায় যেয়ে নেই তারপর বুঝাবো মজা!
আমার মন খারাপ থাকলে ননদ আর শ্বশুর আমাকে মাছের ঘেরে বেড়াতে নিয়ে যেত। সেই সময়টাতে যে আমার কি ভালো লাগতো। ঘের যারা দেখেননি তারা বুঝবেনা এর কি দারুণ সৌন্দর্য। ঝিরিঝিরি বাতাস বয়। ছোট একটা টং ঘরে মাচায় বসে পাহারায় থাকে।
তারপর অনেক সময় পরে দ্বিতীয়বার যাই আমার মেয়ের আকিকা দেবার সময়। তখন আমি খুলনায় থাকি দুইমাসের মেয়েকে নিয়ে। খুলনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টার এ। আমার বরের আবার ভীষণ খেলার নেশা। ফুটবল খেলতে গিয়ে উনি রওনা দিতে বিকেল করে ফেলেছেন। আমাদের সাথে আমার ননদ লুছি আর ছোট বোন লিপু এসেছিল। খুলনা থেকে বিকেলে রওনা দিলেও সাতক্ষীরা পৌঁছাতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। গাড়ী থেকে নেমে ভ্যান নিয়ে এক ঘন্টার মতো যেতে হয়। কিন্তু আমরা বাস থেকে নেমে কোন ভ্যান পাচ্ছিলাম না।
রাত হয়ে গেছে বলে।তাদের জন্য যেটা রাত ছিল আমাদের জন্য সেটাই সন্ধ্যা। ভ্যানতো দূরে থাক একটা মানুষ ও নেই। তাদের ওদিকে হেলিকপ্টার ভাড়া পাওয়া যায়। সাইকেলের পেছনে সীট লাগিয়ে যাত্রী পারাপার। আর এর নাম নাকি হেলিকপ্টার!! তাও পাচ্ছিলাম না। মনে মনে আশায় ছিলাম হয়তো আশাশুনী নামের সাথে মিলের স্বার্থকতা রেখেই আশাশুনি থেকে ভ্যান পেয়ে যাবো। কিন্তু সে আশায়ও গুড়ে বালি।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো হেটেই রওনা দিতে হবে এই ৫ কিলোমিটার পথ।চাপড়া থেকে গোদাড়া গ্রাম পর্যন্ত । সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল এই পথে তখন কাজ চলছিল বলে ইটের খোয়া বিছানো ছিল।জীবনের বন্ধুর পথ বোধহয় একেই বলে।
চারদিকে অমাবস্যার অন্ধকার আর ঝিঝি পোকার ডাক।ক্ষনে ক্ষনে দূরে কুকুর ডেকে উঠছে। পথের দুইধারে মাথাসমান উঁচু সারি সারি বাবলাগাছ। সবকিছু মিলিয়ে কেমন ভৌতিক পরিবেশ। সারাক্ষণই এক আতংকিত পথ চলা। আমি ভাবছিলাম কেন এই সাতক্ষীরার ছেলেকে বিয়ে করতে গেলাম। আমার কান্ড দেখে তারা ভাইবোন শুধু হাসে।আমি কি ভুল করলাম জীবনে। আসলে অজানা পথ দীর্ঘ হয়।
আমি ইটের খোয়ায় হাটতে পারছিলাম না বলে হীল জুতা হাতে নিয়েছি আর হাউমাউ করে অনবরত কেদেই চলছি। আমি দেখছিলাম পুটলির মতো করে ছোট মেয়েটাকে তার বাবা বুকে জড়িয়ে নিয়ে হেটে যাচ্ছে আর পেছন পেছন লিপু আর আমি কখনো দোয়া পড়ছি আর কখনো কান্না করছি। আর সেদিনই আমার বরের বুদ্ধি সুদ্ধির উপর আমি আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। যা হারিয়েছি সেটা আজও ফিরে আসেনি।
অবশেষে রাত এগারোটায় গিয়ে পৌঁছালাম। আমি আরও ভয় পাচ্ছিলাম পথে চোর ডাকাতে ধরে কি-না। বর আর ননদ জানালো তাদের এদিকে চোরই নেই। ডাকাততো দূরে থাক।কথাটার সত্যতা আমি পরে পেয়েছিলাম। আমি দেখেছি তারা রাতে দরজার ছিটকিনি বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পড়ে।অথচ চুরি হয়না।
যাই হোক, সময়ের ব্যবধানে আজ আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এই সাতক্ষীরা, খুলনা। অতুলনীয় এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এখন আমি এখানকার মানুষদের বুঝি। এরা খুবই সরল আর শান্ত। সহনশীল, উচ্চাকাঙ্খা কম,শান্তিপ্রিয়, আর তাই তারা বেশী সুখী মানুষ।
আমার মনে হয় দেশের অন্য সব জেলার চেয়ে সাতক্ষীরার মানুষ বেশী সুখী। এখন আমি প্রতিবছর যাই এই মাছের ঘের এই প্রকৃতি আর এই মানুষদের দেখতে।আমার খুবই ভালো লাগে। এখন তারা শহরে বসবাস করে,তারপর ও শহর থেকে আমি গ্রামে চলে যাই একদিন ঘুরতে।
যেখানে আমার বরের জন্ম,বেড়ে উঠা আর পড়াশোনা করা। গ্রামের মানুষগুলো এখনো দৌড়ে আসে বাছার বউ দেখতে। (সাতক্ষীরায় আদর করে ছেলেকে বাছা আর মেয়েকে নুনু বলে)। যদিও তাদের কথা আমি এখনো ঠিকঠাক বুঝিনা। এখন এই সাপের মতো মসৃণ পথ দেখলে মনেই হয়না এই পথ একদিন কুমীরের চামড়ার মতো এবড়োথেবড়ো ছিল। এখন হেলিকপ্টার উঠে গেছে তার জায়গা দখল করেছে মোটরসাইকেল।,অটোরিকশা, প্রাইভেট কার। শহরের অনেক সুবিধাই এখন বিদ্যমান। আজ এই বাবলা গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন যাই তখন মনে হয় এ যেন স্বপ্নের পথ। দুইদিকে মাছের ঘের আর মাঝখানে এই স্বপ্নের পথ। স্বপ্নেই যেন উড়তে থাকি,ভাসতে থাকি। আর বলতে থাকি..
এই পথ যদি না শেষ, তবে কেমন হতো বলোতো…!!!
স্মৃতিচারণঃ মাহিনুর জাহান নিপু
তথ্য সংগ্রহেঃ সাইফুজ্জামান মিঠুন
(স্টাফ রিপোটার)

Check Also

সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন এর আয়োজনে বিজয় দিবস পালন ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান

নিজস্ব প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় বিজয় দিবস উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,পুরুষ্কার বিতারণ ও আলোচনা সভা  অনুষ্ঠিত হয়েছে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।