রুহুল কুদ্দুস : রোযা অবস্থায় গিবত করলে রোজা ভেঙে যায় না। তবে রোজার সওয়াব ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। গিবত কবিরা গুনাহ। কোরআন মজিদ ও হাদিস শরিফে এর ঘৃণ্যতা ও ভয়াবহতার কথা এসেছে। সাধারণ সময়ই এটি খুবই নিকৃষ্ট কাজ। আর রমজান মাসে রোজা অবস্থায় এর ভয়াবহতা আরো বেশি।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, রোজা হলো (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার) ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসুলুল্লাহ, কিভাবে রোজা বিদীর্ণ হয়ে যায়? নবী করিম (সা.) বললেন, মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা গিবত করার দ্বারা। (আলমুজামুল আওসাত, তাবারানি, হাদিস : ৭৮১০; নাসায়ি, হাদিস : ২২৩৫)
আমি অবাক হই, কিভাবে তোমরা অন্যদের দোষ ত্রুটি নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকো, অথচ নিজেদের কথা ভুলে যাও!” . — ইমাম ইবনুল জাওযী (রহ.)
মাহে রমজানে একজন রোজাদার সারা দিনের ক্লান্তি, অবসাদ ও কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সিয়াম সাধনা করে উন্নত মানবিক গুণাবলি অর্জনে সক্ষম হন। সে জন্য বিশেষভাবে রমজান মাসে পরচর্চা ও পরনিন্দা বর্জনের জন্য রোজাদারদের জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। যতক্ষণ না রোজাদার নিজেই তা ফাটিয়ে ফেলে।’ সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঢাল ফাটাবে কীভাবে?’ জবাবে মহানবী (সা.) বলেন, ‘মিথ্যা ও গিবতের দ্বারা।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে যে পানাহারের মতো মিথ্যাচার ও পরনিন্দার দ্বারা রোজা নষ্ট হয়ে যায়।
সমাজে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য রোজাদারদের মধ্যে কতগুলো সদ্গুণ থাকা দরকার। যেমন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, দানশীলতা, উদারতা প্রভৃতি।
পক্ষান্তরে কতগুলো নিন্দনীয় আচরণ, যা সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট ও ধ্বংস করে, যেমন পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা প্রভৃতি বর্জন করা মানুষের অবশ্যকর্তব্য। কারও দোষ বলে বেড়ানো, কুৎসা রটানো, গিবত করা—এসবই পরচর্চা ও পরনিন্দা। পরচর্চা মানে অন্যের নিন্দা করা, অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা। পরনিন্দা যেমন সমাজে ঘৃণ্যতর, তেমনি তা আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত পাপের কাজ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘নিশ্চিত ধ্বংস ওই সব লোকের জন্য, যারা পেছনে পরনিন্দা করে বেড়ায় এবং সম্মুখে গালাগাল করে।’ (সূরা হুমাজাহ, আয়াত: ১)
একদা নবী করিম (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘গিবত হলো, তুমি তোমার মুসলমান ভাইয়ের বর্ণনা (তার অসাক্ষাতে) এমনভাবে করবে যে সে তা শুনলে অসন্তুষ্টই হবে।’ অতঃপর তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি যা কিছু বলব, তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রেও কি তা গিবত হবে?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তুমি যা বলছ, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে সেটা গিবত হবে। আর যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে তা হবে “বুহতান” বা মিথ্যা অভিযোগ।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তাঁর সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কি জেনার চেয়ে মারাত্মক?’ তিনি বললেন: ‘হ্যঁা! কেননা কোনো ব্যক্তি জেনা করার পর (বিশুদ্ধ) তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না।’ (মুসলিম) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গিবতের কাফফারা হলো এই যে ‘তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি দোয়া এভাবে করবে যে “হে আল্লাহ! তুমি আমার এবং তার গুনাহ মাফ করে দাও।”’ (বায়হাকি)
গিবত বা পরচর্চায় পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়, মানবসমাজে শান্তি বিনষ্ট হয়। যে পরনিন্দা করে তাকে কেউ বিশ্বাস করে না এবং ভালোবাসে না। একজনের দুর্নাম অন্যের কাছে করলে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়, কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘বিচারের দিবসে লোকদের কাছে তার আমলনামা তুলে ধরা হবে। তখন সে বলবে, “হে আমার রব! দুনিয়ার জীবনে আমি এই এই কাজ করেছিলাম। কিন্তু আমার আমলনামায় তা দেখছি না।” উত্তরে আল্লাহ বলবেন, “অন্যের গিবত করার কারণে তোমার আমলনামা থেকে তা মুছে ফেলা হয়েছে।”’ (তারগিব ও তারহিব)
গিবত করা যেমন নিষেধ, তেমনি গিবত শোনাও নিষেধ। যে গিবত শোনে, সেও গিবতের পাপের অংশীদার হয়ে যায়। পরচর্চা ও পরনিন্দার পরিণতি সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম) তিনি মানুষকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পর কলহ করবে না, হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করবে না, একে-অন্যকে ঘৃণা করবে না, অন্যের ক্ষতি সাধনের কোনো কৌশল অবলম্বন করবে না, আর তোমরা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি ও মুসলিম) পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি বেশি ধারণা বা সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা বা সন্দেহ গুনাহ ও মানুষের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারও পেছনে দোষচর্চা না করে।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১২)
পরনিন্দা যেমন হারাম, তদ্রূপ কারও অসাক্ষাতে দুর্নাম বা গিবত করাও হারাম। গিবত হচ্ছে কারও অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে তার এমন কোনো দোষের কথা বলা, যা সে শুনলে মনে কষ্ট পাবে। যারা ভালো মানুষ, তারা অন্যের গুণ প্রকাশ করে, দোষ বলে না। আর যারা নিজেরা খারাপ, তারা অন্যদের খারাপ মনে করে। তারা মানুষের গুণ দেখে না, দোষ খুঁজে বেড়ায়, কুৎসা রটনা করে। গিবত করা জঘন্য ও ঘৃণার কাজ। ত্রুটিমুক্ত রোজার মাধ্যমেই মুমিন তাঁর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হবেন। যেমন রোজা রেখে পরচর্চা, পরনিন্দা ও মিথ্যা দোষারোপ করবেন না এবং যত প্রকার গুনাহর কাজ আছে, তা বর্জন করবেন। সুতরাং মাহে রমজানে যাবতীয় অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড, অসদাচরণ, কথাবার্তা ও অবৈধ লেনদেন থেকে বিরত থাকুন এবং পরচর্চা ও পরনিন্দা পরিহার করুন।
মাহে রমজানের একটি মাসে সিয়াম সাধনার কঠিন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিটি রোজাদার মুসলমান যদি পরচর্চা ও পরনিন্দা বর্জনের প্রাত্যহিক অভ্যাস গড়ে তোলেন, তাহলে সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার, পাপাচার বিলুপ্ত হয়ে পৃথিবী শান্তির আবাসস্থলে পরিণত হতে বাধ্য। অতএব, মাহে রমজানের শিক্ষা অনুযায়ী রোজাদারদের সর্বাবস্থায় পরচর্চা ও পরনিন্দা পরিহার করা উচিত।
মাওলানা রুহুল কুদ্দুস :কামিল (হাদীস বিভাগ) :সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদ্রাসা।(লেখক ক্রাইমর্বাতা ডক কম)