আব্দুল আলিম মোল্যা:( চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সাতক্ষীরা) ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত কল্যাণকর, পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাই এতে স্বাস্থ্যনীতিও রয়েছে। দেহকে অযথা কষ্ট দেয়া ইসলামের বিধি নয়। রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। সকল সক্ষম ঈমানদারদের উপর আল্লাহ রমযানের একমাস রোজা ফরজ করেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাহদেরকে নিছক কষ্ট দেয়ার জন্যে এটা ফরজ করেননি। তিনি এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন,
‘‘ওয়া আনতা সুউমু খাইরুল লাকুম ইন্কুনতুম তা’লামুন’’- অর্থাৎ- ‘‘তোমরা যদি রোজা রাখ তবে তাতে রয়েছে তোমাদের জন্য কল্যাণ, তোমরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে পার।’’ (সূরা বাকারাহ- ১৮৪)
ইউরোপের ঘরে ঘরে ইদানীং রোজা করার হিড়িক পড়েছে। সবার মুখে এক কথা- শরীরটাকে ভালো রাখতে চাওতো রোজা কর। এ ধরনের চেতনা সৃষ্টির পিছনে সত্তর দশকে প্রকাশিত একটি বই বিশেষত: দায়ি। বইটি হচ্ছে প্রখ্যাত জার্মান চিকিৎসাবিদ ড. হেলমুট লুটজানার-এর The Secret of Successful Fasting অর্থাৎ উপবাসের গোপন রহস্য। বইটিতে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করে নিরোগ, দীর্ঘজীবী ও কর্মক্ষম স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হলে বছরের কতিপয় দিন উপবাসের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ড. লুটজানারের মতে, খাবারের উপাদান থেকে সারাবছর ধরে মানুষের শরীরে জমে থাকা কতিপয় বিষাক্ত পদার্থ (টকসিন), চর্বি ও আবর্জনা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র সহজ ও স্বাভাবিক উপায় হচ্ছে উপবাস। উপবাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরে দহনের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে শরীরের ভিতর জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থসমূহ দগ্ধীভূত হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, ‘রমযান’ শব্দটি আরবির ‘রমজ’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া ও পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে ধ্বংস না হলে, ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগব্যাধির জন্ম দেয়। এছাড়াও উপবাস কিড্নী ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি ও মনে সজীবতার অনুভূতি এনে দেয়।
রোজা পালনের ফলে মানুষের শরীরে কোন ক্ষতি হয় না বরং অনেক কল্যাণ সাধিত হয়, তার বিবরণ কায়রো থেকে প্রকাশিত ‘Science Calls for Fasting’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন, “The power and endurance of the body under fasting conditions are remarkable : After a fast properly taken the body is literally born afresh.”
অর্থাৎ রোজা রাখা অবস্থায় শরীরের ক্ষমতা ও সহ্যশক্তি উল্লেখযোগ্য : সঠিকভাবে রোজা পালনের পর শরীর প্রকৃতপক্ষে নতুন সজীবতা লাভ করে।
রোজা একই সাথে দেহে রোগ প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। রোজাব্রত পালনের ফলে দেহে রোগ জীবাণুবর্ধক জীর্ণ অন্ত্রগুলো ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বাধাপ্রাপ্ত হয়। দেহে ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন প্রকার নার্ভ সংক্রান্ত রোগ বেড়ে যায়। রোজাদারের শরীরের পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার ফলে চর্মরোগ বৃদ্ধি পায় না।
ডা. জুয়েলস এমডি বলেছেন, ‘‘যখনই একবেলা খাওয়া বন্ধ থাকে, তখনই দেহ সেই মুহূর্তটিকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে।’’
ডা. আলেক্স হেইগ বলেছেন, ‘‘রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়। স্মরণশক্তি বাড়ে, মনোসংযোগ ও যুক্তিশক্তি পরিবর্ধিত হয়। প্রীতি, ভালোবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি প্রভৃতি বেড়ে যায়। এটা খাদ্যে অরুচি ও অনিচ্ছা দূর করে। রোজা শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনীশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তাদেরকেও আমি রোজা পালন করতে বলি।’’
বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড নারায়াড বলেন, ‘রোজা মনস্তাত্ত্বিক ও মস্তিষ্ক রোগ নির্মূল করে দেয়। মানবদেহের আবর্তন-বিবর্তন আছে। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির শরীর বারংবার বাহ্যিক চাপ গ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি দৈহিক খিচুনী এবং মানসিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয় না।’’
১৯৫৮ইং সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডাঃ গোলাম মুয়াযযম সাহেব কর্তৃক ‘‘মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব’’ সম্পর্কে যে গবেষণা চালানো হয়, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোযার দ্বারা মানব শরীরের কোন ক্ষতি হয় না। কেবল ওজন সামান্য কমে। তাও উল্লেখযোগ্য কিছুই নহে, বরং শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে এরূপ রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ (ঊধর্ণ উমর্ভরমফ) অপেক্ষা বহুদিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। ১৯৬০ ইং সালে তার গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করে রোজা দ্বারা পেটের শূলবেদনা বেড়ে যায়, তাদের এ ধারণা নিতান্ত অবৈজ্ঞানিক। কারণ উপবাসে পাকস্থলীর এসিড কমে এবং খেলেই এটা বাড়ে। এ অতি সত্য কথাটা অনেক চিকিৎসকই চিন্তা না করে শূলবেদনার রোগীকে রোজা রাখতে নিষেধ করেন। ১৭ জন রোজাদারের পেটের রস পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, যাদের পাকস্থলীতে এসিড খুব বেশি বা খুব কম রোজার ফলে তাদের এ উভয় দোষই নিরাময় হয়েছে। এ গবেষণায় আরো প্রমাণিত হয় যে, যারা মনে করেন রোজা দ্বারা রক্তের পটাসিয়াম কমে যায় এবং তাতে শরীরের ক্ষতি সাধন হয়, তাদের এ ধারণাও অমূলক। কারণ পটাসিয়াম কমার প্রতিক্রিয়া প্রথমে দেখা যায় হৃদপিন্ডের উপর অথচ ১১ জন রোজাদারের হৃদপিন্ড অত্যাধুনিক ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্রের সাহায্যে (রোজার পূর্বে ও রোজা রাখার ২৫ দিন পর) পরীক্ষা করে দেখা গেছে রোজা দ্বারা তাদের হৃদপিন্ডের ক্রিয়ার কোনই ব্যতিক্রম ঘটে নাই।
রোজা থেকে শারীরিক ফায়দা লাভের জন্যে রোজাদারদের প্রতি ডাঃ আমীর আই, আহমদ আনকাহর কতিপয় মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলো নীচে দেয়া হলো –
১. যদি আপনি বিত্তবান হোন তবে অধিক ভোজন ও চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার করে চলুন। রোজা রেখে সুস্থ থাকুন- এ প্রতীক গ্রহণ করুন।
২. সহায় সম্বলহীন আপন ভাইকে সাহায্য করুন।৩. রমযান মাস সম্পদশালীদের জন্যে নিবেশ আর গরীবদের জন্য ভালো খাবার মাস মনে করুন।৪. দিনের বেলা ক্ষুৎপিপাসার তাড়না থেকে মুক্তি পেতে হলে রাতে অতিরিক্ত চিনি, লবণ ও চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার করুন।৫. খাদ্য ভালোভাবে চিবিয়ে খান।৬. খাবার ব্যবস্থা করতে না পারলে শুধুমাত্র দুধের উপর নির্ভর করতে পারেন।৭. যথাসম্ভব ইফতার তাড়াতাড়ি আর সেহেরী দেরীতে খাওয়া ভালো।৮. সেহরী খেয়ে সটান না হয়ে বিনিদ্র রজনী যাপন করুন। তাতে খাদ্য ঠিকমত হজম হয়।৯. ইফতারের পর চটপটি জাতীয় এবং ঠান্ডা জিনিস অধিক পরিমাণে গ্রহণ করবেন না।১০. সারাদিন কাজে লিপ্ত থাকুন। ক্ষুৎপিপাসা ভুলতে চেষ্টা করবেন না।১১. রমযান মাসে নেক কাজ ও ত্যাগ তিতিক্ষার যে অভ্যাস আপনার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে, তা সবসময় চালু রাখুন।১২. জীবনের চড়াই উৎরাই সবসময় রোজার দাবিকে সমুন্নত রাখুন।১৩. কু-চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত থাকুন। কুচিন্তা বিষসদৃশ যা স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয়। কুচিন্তা ও কুধারণার উপশম না ওষুধে হয় না খাদ্যে।
তিরমিজি শরীফে এসেছে রাসূল (সা.) মাগরিবের নামাজের পূর্বে কয়েকটি তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। খেজুর না থাকলে কয়েক কোশ পানিই পান করতেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেন না এতে বরকত রয়েছে। যদি খেজুর না পায় তবে যেন পানি দ্বারা ইফতার করে। কারণ পানি হলো পবিত্রকারী।’
“হে ইমানদার গণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পারো। ”
(সুরা আল বাকারা ১৮৩)
কুরআনের ঘোষনা থেকে আমরা কয়েকটা বিষয় জানতে পারলাম।
১। আমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।
২। আমাদের পূর্ববর্তীদের উপরও ফরজ করা হয়েছিলো।
৩। রোজা ফরজ করা হয়েছে আমাদের তাক্বওয়া অর্জনের জন্য।
** প্রথমে আমরা জেনে নেই রোজা কি?
রোজা ইসলামের ৫ টি স্তম্ভের একটি।
রোজা ফারসি শব্দ। আরবিতে এর প্রতি শব্দ হচ্ছে সাওম। যার বহু বচনে হয় সিয়াম (রোজা)।
অর্থ: বিরত থাকা বা বিরত রাখা।
অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত সকলপ্রকার খানা পিনা যৌন চাহিদা থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। কেবল উপবাস থাকার নাম রোজা নয়। সকল অন্যায় কাজ থেকে আমাদের বিরত থাকার শিক্ষা দেয় পবিত্র রমজান।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,,,,আল্লাহ্ বলেন, রোজা ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।( সহীহ্ মুসলিম)
রাসুল সা: আরও বলেন,
যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় ও জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানকে বন্দী করা হয়। (বুখারী ও মুসলিম)৮ শ্রেনীর মানুষের উপর রোজা ফরজ।
১। মুসলমান। ২। বালেগ ৩। সুস্থ্য ব্যক্তি ৪। সুস্থ্য মস্তিস্কের ৫। স্বাধীন ব্যক্তি ৬। সজ্ঞান ব্যক্তি ৭। মুকিম ( মুসাফিরের জন্য ছাড় আছে) ৮। তাহিরা ( পবিত্র হওয়)।এবার আসুন জানার চেষ্টা করি তাক্বওয়া কি? যেটা অর্জন করতে আমাদের মাঝে এসেছে রমজান।** তাক্বওয়া অর্থ ভয় করা, বেঁচে থাকা, সতর্ক হওয়া ইত্যাদি।আল্লাহ্ বলেন, হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। যেমনভাবে ভয় করা উচিৎ।
(সুরা ইমরান ১০২)”তোমরা আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করো।”(সুরা আত-তাগাবুন ১৬)”তোমরা আল্লাহকে ভয় করো ও সঠিক কথা বলো।”
(সুরা আল আহযাব ৭০)”তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে ভালো মন্দের মধ্য পার্থক্যকারী হবার যোগ্যতা দান করবেন, তোমাদের গুনাহ্ মাফ করবেন। আল্লাহ্ বড়ই মহান।”
(সুরা আনফাল ২৯)সম্মানিত পাঠক, তাহলে আমরা কয়েকটা আয়াত পাছে জানতে পারলাম আল্লাহ্ চান আমরা তাকে ভয় করি। যথাসাধ্য ভয় করি। আর এই ভয় পেলেই আমরা তাক্বওয়া অর্জন করবো। রোজার দাবী এটাই।কিন্তু আমরা কি ভয় পাই?আমরা আমাদের অফিসের বসকে যতো ভয় পাই,
আমরা একটা পশু বাঘকে যতো ভয় পাই,আমরা একটা সাপকে যতো ভয় পাই,আমরা ভাইরাস করোনাকে যতো ভয় পাই,
ঠিক ততোটা ভয় কি আল্লাহকে পাই? অথচ এগুলোর কোনো ক্ষমতা নেই। এরা সবাই এক আল্লাহর আনুগত্য করে। তাঁরই হুকুম পালন করে। আমরা কতো বোকা !!তাই আসুন কোনো সৃষ্টিকে নয়। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করি। তাহলে আমরা তাক্বওয়াবান হতে পারবো। কামিয়াবী হবো দুনিয়া ও আখেরাতে। মহান আল্লাহ্ আমাদের রোজার দাবী আদায়ের সামর্থ্য দিন। আমিন।
আব্দুল আলিম মোল্যা
রেকর্ড কিপার
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত
সাতক্ষীরা।