দৃশ্যপট-১: সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স চলছিল প্রধানমন্ত্রীর। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা সার্বিক পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এরইমধ্যে সংকটের কথা জানান নারায়ণগঞ্জের খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শামসুদ্দোহা। এন-৯৫ মাস্কের সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। বলেন, এন-৯৫ মাস্ক আমার হাসপাতালে আমি একটাও পাইনি, অথচ আমি কিন্তু করোনা চিকিৎসায় থেমে থাকি নাই। ওই হাসপাতালের ১৬ চিকিৎসক কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কথাও জানান তিনি। একইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের অনুরোধ জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য জানতে চান। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নারায়ণগঞ্জে ল্যাব চালুর সার্বিক কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ইতিমধ্যে পিসিআর মেশিন পৌঁছেছে।
দৃশ্যপট-২: বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট শুরু থেকেই গাফিলতি করে আসছে। তারা কোন কার্যকর উদ্যোগ না নিয়েই বলে আসছিলেন, সব ঠিক আছে। সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া আছে। মুখস্থ বুলি তাদের মুখে প্রতিদিনই শোনা যেতো। পিপিইর সংকট নেই, মাস্কের সংকট নেই। এটা সত্য সারা পৃথিবীতেই এখন সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট। বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানকার কর্তাব্যক্তিরা বলে আসছিলেন, এসবের কোন সংকট নেই। কিন্তু তাদের কথার যে কোন সত্যতা নেই তা একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায় করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ার শুরুর দিকেই। হাসপাতালে হাসপাতালে দেখা যায়, পিপিই নেই, মাস্ক নেই। একের পর এক চিকিৎসক আক্রান্ত হতে থাকেন। বাংলাদেশে এরইমধ্যে নয় শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের হার আমাদের দেশেই পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ। এ আক্রান্তের জন্য কয়েকটি কারণকে দায়ী করা হচ্ছে। তার মধ্যে সুরক্ষা সামগ্রীর মান অন্যতম। এই সিন্ডিকেট করোনার টেস্টের পরিমানও একেবারে সীমিত রাখে। এখন অবশ্য প্রতিদিনই টেস্টের হার বাড়ছে।
দৃশ্যপট -৩: ব্লগার অমি রহমান পিয়াল তার ফেসবুক টাইমলাইনে একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, মাত্র ক’দিন আগেই রাজশাহী বিভাগের সিভিল সার্জনদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সেই ভিডিও কনফারেন্সের আগে আরেকটি মিনি কনফারেন্সে বসতে হয়েছিলো ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তরফে পরিচালিত সেই কনফারেন্সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো প্রধানমন্ত্রীকে কি বলা যাবে না, কি জানানো যাবে না, কি প্রশ্ন করা যাবে না। এন-নাইনটি ফাইভ মাস্ক এবং পিপিই সম্পর্কিত কোনো তথ্য প্রদানের নিষেধাজ্ঞা ছিলো প্রচ্ছন্ন হুমকির সেই বৈঠকে।
দৃশ্যপট-৪: করোনার এই দুর্যোগের সময় তথ্যের স্বচ্ছতা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের ওপর জোর দিচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাঁটছে উল্টোপথে। বেশ কিছু দিন হলো, তাদের সংবাদ ব্রিফিং এ কোনো প্রশ্ন করা মানা। যেন স্বচ্ছতাতেই তাদের যতো অনিহা। তারা এর নাম দিয়েছে অনলাইন বুলেটিন। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা নিয়ে প্রতিদিনই বিভ্রান্তি বাড়ছে। কিন্তু এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যায় না। ডনাল্ড ট্রাম্প অথবা বরিস জনসনকে সাংবাদিকরা করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও প্রশ্নের উর্ধ্বে। মিডিয়ায় যেন চিকিৎসক ও নার্সরা বক্তব্য না দেন তা নিয়েও নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
দৃশ্যপট-৫: করোনা ভাইরাস চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতাল নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তার অন্যতম ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। এ হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন শহিদ মো. সাদিকুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় ঔষাধাগার থেকে দেয়া মাস্কের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই পরিচালক। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠিও লিখেছিলেন। বুধবার তাকে ওএসডি করা হয়েছে। এরআগে মাস্ক ও সুরক্ষা পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তোলায় নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক আবু তাহেরকে শোকজ করা হয়। আরো কয়েকজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
শেষ কথা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক, যিনি সার্জন হিসেবে অল্প বয়সেই খ্যাতি পেয়েছেন। ছাত্র জীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ক’দিন আগে বলছিলেন, চিকিৎসকরা যেসব সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন তা মানসম্মত নয়। তিনি নিজেও এন-৯৫ মাস্ক পাননি। তিনি বলছিলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরছে না। ওই চিকিৎসকও সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হন। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে যেন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা সমস্যা সংকটের কথা বলতে না পারেন তার জন্য তৎপর রয়েছে ওই সিন্ডিকেট। তাদের নীতি হচ্ছে, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন না।’ অথচ এই সংকটের মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রীকে জানানোই প্রয়োজন সর্বাগ্রে।http://mzamin.com