যাকাত গরীবের হক্ব ধনীদের করুনা নয়

  আব্দুল আলিম মোল্যা: সম্মানিত পাঠক, আসছালামু আলাইকুম। পবিত্র মাহে রমজানে আমরা মহান রবের নৈকট্য হাসিলের জন্য রোজা পালন করছি।। এ মাসে মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক এবাদাতের বিনিময়ে অনেক বেশি নেকি প্রদান করেন। তাই এই মাসে আমরা যাকাতও আদায় করি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যাকাত কি, যাকাত কে দিবে বা কাকে দিবে ইত্যাদি। আসুন জানার চেষ্টা করি যাকাত সম্পর্কে।
ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি হলো যাকাত। প্রতিবছরই যাকাত দিতে মুমিন মুসলমানরা সচেষ্ট থাকেন। গরিব দুঃখীকে দান করে আল্লাহর কাছে প্রিয় হবার জন্য চেষ্টা করেন।

যাকাত কী এবং কেন?

যাকাত শব্দের অর্থ পরিচ্ছন্নতা। নিজের আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ কম সৌভাগ্যবান মানুষকে দান করে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধিই যাকাত। শরীয়তের ভাষ্যে, বাৎসরিক আয়ের ২.৫% অংশ আল্লাহের পথে দান করে দেয়ার নাম যাকাত। এতে সম্পদ হয় হালাল এবং আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। রাসূল (স) এর মতে, “যে ব্যক্তি যাকাত দিল তার থেকে যেন শয়তান নির্মূল হয়ে গেল।”

কারা দেবেন যাকাত?

যাকাত দেয়ার জন্যে একজন মুসলিমের ‘সাহিবে নিসাব’ হতে হবে অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নিসাব বলতে বোঝায় ন্যূনতম যে পরিমাণ ধন-সম্পদ থাকলে যাকাত আদায় করা ফরজ। ফিকহ অনুসারে নিসাব পরিমাপ করা হয়ে থাকে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের হিসাব অনুসারে, এই পরিমাণ হচ্ছে ৭.৫ তোলা স্বর্ণ কিংবা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য অথবা সমপরিমাণ অর্থ।

যে ব্যক্তি এক বছর যাবত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকেন, তাকে মোট অর্থের শতকরা ২.৫% হারে যাকাত পরিশোধ করতে হবে। অধিক সওয়াবের আশায় বেশিরভাগ মুসলমানই যাকাত দেবার জন্যে পবিত্র রমজান মাসকে বেছে নেন।

ইসলামের দৃষ্টিতে

ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। যাকাত ধনীর অর্থে গরীবের হক্ব। এটা দান বা করুনা নয়। এটা তাদের পাওনা। অর্থের মালিক মহান আল্লাহ্। আর এটা তাঁরই নির্ধারিত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে। আসুন পবিত্র কুরআনে যাকাতের কিছু নির্দেশনা জেনে নেয়।
** তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। -সূরা বাকারা : ১১০
** তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’-সূরা নূর : ৫৬ ** এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’ (নিসা ১৬২) **
তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা তাওবা : ১০৩ **
আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। -সূরা আলইমরান : ১৮০ **
হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমরা পুঞ্জিভূত সম্পদ।’ -সহীহ বুখারী
যে সম্পদের উপর যাকাত ফরয হয়েছে তার চল্লিশ ভাগের একভাগ (২.৫০%) যাকাত দেওয়া ফরয। সম্পদের মূল্য নির্ধারণ করে শতকরা আড়াই টাকা হারে নগদ টাকা কিংবা ওই পরিমাণ টাকার কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও যাকাত আদায় হবে। (সুনানে নাসায়ী, সুনানে আবু দাউদ) উপরের আলোচনা থেকে যাকাতের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা এবং এর সুফল ও উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা পেলাম। এখান থেকে এ বিষয়টাও অনুমান করা যায় যে, ফরয হওয়া সত্ত্বেও যারা যাকাত আদায় করে না তারা কত বড় ক্ষতিগ্রস্ত-তার শিকার!

প্রিয়_পাঠক এবার আমরা জানবো যাকাত কে দিবেন? কার উপর কি কি জিনিস থাকলে যাকাত ফরজ হয় ?

যাকাত ইসলামের একটি অপরিহার্য ইবাদত। এজন্য শুধু মুসলমান যাকাত আদায়ের জন্য নির্দেশিত। সুস্থ্যমস্তিষ্ক, স্বাধীন, বালেগ মুসলমান নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে যাকাত আদায় করা তার ওপর ফরয হয়ে যায়। কোনো কাফির, মুশরিকের উপর যাকাত প্রদানের হুকুম নেই। কারণ তারা এবাদাতের যোগ্যতা রাখে না।

এছাড়া অসুস্থ্যমস্তিষ্ক মুসলিমের ওপর এবং নাবালেগ শিশু-কিশোরের ওপরও যাকাত ফরয নয়।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৬১-৪৬২; রদ্দুল মুহতার ২/২৫৯ রদ্দুল মুহতার ২/২৫৮।

#যেসব_জিনিসের_উপর_যাকাত_ফরয_হয় :

১। সব ধরনের সম্পদ ও সামগ্রীর ওপর যাকাত ফরয হয় না। শুধু সোনারুপা, টাকা-পয়সা, এবং ব্যবসার পণ্যে যাকাত ফরয হয়।

তবে সোনা-রুপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতুর অলংকার ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তদ্রূপ হিরা, মণি-মুক্তা ইত্যাদি মূল্যবান পাথর ব্যবসাপণ্য না হলে সেগুলোতেও যাকাত ফরয নয়।
(-কিতাবুল আছার মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৭০৬১-৭০৬৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৪৪৭-৪৪৮)

২। মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্ধৃত্ত টাকা-পয়সা নিসাব পরিমাণ হলে এবং এক বছর স্থায়ী হলে বছর শেষে তার যাকাত আদায় করা ফরয হয়।

৩। ব্যাংক ব্যালেন্স, ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড, সার্টিফিকেট ইত্যাদিও নগদ টাকা-পয়সার মতোই। এসবের ওপরও যাকাত ফরয হয়।

৪। টাকা-পয়সা ব্যবসায় না খাটিয়ে এমনি রেখে দিলেও তাতে যাকাত ফরয হয়। তেমনি ছেলে-মেয়ের বিয়ে-শাদি ইত্যাদি প্রয়োজনের জন্য যে অর্থ সঞ্চয় করা হয় তার উপরও যাকাত ফরজ।

৫। দোকান-পাটে যা কিছু বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা থাকে তা বাণিজ্য-দ্রব্য। এর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত আদায় করা ফরয।
(-সুনানে আবু দাউদ / মুয়াত্তা ইমাম মালেক।)

৬। ব্যবসার নিয়তে কোনো কিছু ক্রয় করলে তা স্থাবর সম্পত্তি হোক যেমন জমি-জমা, ফ্ল্যাট কিংবা অস্থাবর যেমন মুদী সামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অলংকার, নির্মাণ সামগ্রী, গাড়ি, ফার্নিচার, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, হার্ডওয়ার সামগ্রী, বইপুস্তক ইত্যাদি, তা বাণিজ্য-দ্রব্য বলে গণ্য হবে এবং মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে যাকাত দেওয়া ফরয হবে।
(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭১০৩,৭১০৪)

* স্বর্ণ রৌপ্য কতোটুকু হলে যাকাত ফরজ?

@ স্বর্ণের ক্ষেত্রে যাকাতের নিসাব হল বিশ মিসকাল। (সুনানে আবু দাউদ)

আধুনিক হিসাবে সাড়ে সাত ভরি।

@ রুপার ক্ষেত্রে নিসাব হল দু’শ দিরহাম। (সহীহ বুখারী,সহীহ মুসলিম,)

আধুনিক হিসাবে সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এ পরিমাণ সোনা-রুপা থাকলে যাকাত দিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে,
যদি সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা কিংবা বাণিজ্য-দ্রব্য- এগুলোর কোনোটি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু এসবের একাধিক সামগ্রী এ পরিমাণ রয়েছে, যা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্য বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে এক্ষেত্রে সকল সম্পদ হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস ৭০৬৬,৭০৮১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৯৩)

#কোন_কোন_জিনিসের_ওপর_যাকাত_ফরয_নয় :

* নিজের ও পরিবারের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও বাহনের ওপর যাকাত ফরয নয়।

* গৃহের আসবাবপত্র যেমন খাট,চেয়ার,টেবিল, ফ্রিজ, আলমারি, হাড়িপাতিল, থালাবাটি, গ্লাস ইত্যাদির উপর যাকাত ফরয নয়। তা যত উচ্চমূল্যেরই হোক না কেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক)

* পরিধেয় বস্ত্র, জুতা যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশিও থাকে তবুও তাতে যাকাত ফরয হবে না।

* দোকান-পাট বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমন আসবাবপত্র যা ব্যবসাপণ্য নয়, তার ওপর যাকাত ফরয নয়। তবে ফার্নিচারের দোকানে বিক্রির উদ্দেশ্যে যেসব ফার্নিচার রাখা থাকে তা যেহেতু বাণিজ্যদ্রব্য তাই এসবের ওপর যাকাত ফরয হবে।

* ঘর-বাড়ি বা দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিলে তাতেও যাকাত ফরয নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ যে অর্থ পাওয়া যাবে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে।

এখানে মনে রাখতে হবে,
“একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই যাকাত প্রদান করতে হবে। জনসমর্থন অর্জনের জন্য, লোকের প্রশংসা কুড়ানোর জন্য কিংবা অন্য কোনো জাগতিক উদ্দেশ্যে যাকাত দেওয়া হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
(সূরা বাক্বারা ২৬৪)

** #কাদেরকে_যাকাত_দিতে_হবে?

যাকাত প্রদানের খাত স্বয়ং আল্লাহ্ বলে দিয়েছেন।
“যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।”
(সূরা তাওবা : ৬০)

* আসুন এবার জেনে নেয় কোথায় কাকে যাকাত দেওয়া যাবে না :

ক) যদি প্রবল ধারণা হয় যে, যাকাতের টাকা দেওয়া হলে উক্ত লোকটি সেই টাকা গুনাহের কাজে ব্যয় করবে তাহলে তাকে যাকাত দেওয়া জায়েয নয়।

খ) যাকাত শুধু মুসলমানদেরকেই দেওয়া যাবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমকে যাকাত দেওয়া হলে যাকাত আদায় হবে না। তবে নফল দান-খায়রাত অমুসলিমকেও করা যায়।
(মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক/মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা)

গ) জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে যেমন রাস্তা-ঘাট, পুল নির্মাণ করা, কুপ খনন করা, বিদ্যুত-পানি ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে যাকাতের টাকা খরচ করা যাবে না।

ঘ) যাকাতের টাকা দ্বারা মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করা, ইসলাম প্রচার, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা দেওয়া, ওয়াজ মাহফিল করা, দ্বীনি বই-পুস্তক ছাপানো, ইসলামী মিডিয়া তথা রেডিও, টিভির চ্যানেল করা ইত্যাদিও জায়েয নয়।

মোটকথা, যাকাতের টাকা এর হক্বদারকেই দিতে হবে। কুরআনে বর্ণিত খাতেই। অন্য কোনো ভালো খাতে ব্যয় করলেও যাকাত আদায় হবে না।

মহান আল্লাহ্ আমাদের যথাযথ ভাবে যাকাত আদায়ের তৌফিক দিন। আমিন।-(৩)

আব্দুল আলিম মোল্যা
রেকর্ড কিপার
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত
সাতক্ষীরা।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।