ক্রাইমর্বাতা ডেস্ক রিপোর্ট: নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পরে বাংলাদেশি সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে পুলিশি হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এ ঘটনাটি ঘটেছে তাকে সর্বশেষ যেখানে দেখা গিয়েছিল, সেখান থেকে ১৫০ মাইল দূরে সীমান্ত শহরে। বাংলাদেশে বহুল বিতর্কিত নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনি ও অন্য ৩১ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। এর একদিন পরেই মার্চের শুরুর দিকে নিখোঁজ হন কাজল। তারপর টেলিফোনে গত রোববার তিনি প্রথমবার পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ছেলেকে ফোন করে তিনি বলেন, আমি বেঁচে আছি। এটাই ছিল নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে তার প্রথম কথা। এ কথা শুনেই পরিবারের সদস্যরা দ্রুত তার সঙ্গে দেখা করতে যান।
কিন্তু আদালতে তার সঙ্গে সামান্য দু’চারটে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন তারা। কারণ, তাকে অনুপ্রবেশ ও ফেসবুকে পোস্টের দায়ে জেল দেয়া হয়েছে। তার ফেসবুক পোস্ট বাংলাদেশের ‘উচ্চ মাত্রায় নিষ্পেষণমুলক’ (হাইলি রিপ্রেসিভ) ইন্টারনেট আইনে ফাউল বা অন্যায় বলে বিবেচিত হয়। কাজলের ছেলে মনোরম পলক তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাত করার পরে তার সম্পর্কে বলেছেন, তিনি ছিলেন ভীত, উদ্বিগ্ন। তিনি কাঁদছিলেন। দু’একটি বাক্য বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাত বছরের জেল হতে পারে কাজলের। অন্যদিকে বাংলাদেশের জেলখানায় আসামীরা গাদাগাদি করে অবস্থান করেন। তার মধ্যে করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ থেকে তাকে রক্ষা করতে তার পরিবার কর্তৃপক্ষের কাছে অনুনয় বিনয় করছে। তার ছেলে পলক তার পিতার সম্পর্কে বলেছেন, তিনি ঝুঁকিতে আছেন। তাই আমরা ঘুমাতে পারি না। খেতে পারি না। পলক আরো বলেছেন, তার পরিবার এখনও উদ্বিগ্ন এ নিয়ে যে, গত প্রায় দুটি মাস তার পিতা কোথায় ছিলেন, তা তারা এখনও জানতে পারেন নি। এমনকি তার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে কিনা তাও তারা জানতে পারেন নি। তার দাবি ‘আমার পিতা একজন ক্রিমিনাল নন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিই সহিংস অপরাধ নয়। আমরা জানি না দেশে উপচেপড়া জেলখানায় তিনি কতদিন করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে পারবেন।
মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলোর মতে, গত ১০ই মে জোরপূর্বক গুম করা হয়ে থাকতে পারে কাজলকে। এর একদিন আগে ফেসবুকের একটি পোস্ট শেয়ারিং দেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ক্ষমতাসীন একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতা। তাতে দাবি করা হয়, এই পোস্টে আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। তার পরিবার যে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, কাজল নিখোঁজ হওয়ার আগে তার মোটরবাইকের আশপাশে ঘোরাফেরা করছেন তিনজন ব্যক্তি। অ্যামনেস্টি বলেছে, ক্ষমতাসীন দলের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কথিত যৌনতা-পাচার চক্রে জড়িত থাকার বিষয়ে সমালোচনা করে একটি পোস্ট দিয়েছেলেন কাজল। এরপরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক গ্রুপ রিপোর্টার্স সানস ফ্রন্টিয়ার্স (আরএসএফ) বলেছে, কাজলকে গ্রেপ্তার করা গভীর হতাশার বিষয়। আরএসএফের এশিয়া প্যাসিফিক প্রধান ডানিয়েল বাস্টার্ড বলেছে, আমরা বাংলাদেশি প্রসিকিউটরের অফিসের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই সাংবাদিককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং একই সঙ্গে এতটা দিন তাকে কিভাবে অপহরণ করে রাখা হয়েছিল সে বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী টিম গঠন করতে। কারণ, এই অপহরণ ঘটনা অত্যন্ত রহস্যময়।
২০১৮ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে ১০০০ মামলা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষক অধিকার-এর মতে, এই আইনটি বেশি ব্যবহার করেছেন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা।
বুধবার বাংলাদেশি সুপরিচিত ৩ শতাধিক ব্যক্তি একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। ওই চিঠিতে এ সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা একজন কার্টুনিস্ট, একজন লেখক ও একজন অধিকারকর্মীসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে স্বাক্ষরদানকারীদের একজন হলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোসাংবাদিক ড. শহিদুল আলম। ২০১৮ সালে ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কভার করার পর তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। অধিকার-এর মতে এ বছরের প্রথম তিন মাসে পেশাগত কাজের জন্য বাংলাদেশে ৫৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, হামলা, হুমকি দেয়া হয়েছে অথবা আহত করা হয়েছে। অধিকার-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫৫০ জন মানুষকে গুম করা হয়েছে।