প্রেক্ষাপট :—– আল্লাহ সেদিন তাঁর রাসূল (সা.) ও মোমিনদের বিজয়ী এবং কাফির ও মুশরিকদের পরাজিত করার মাধ্যমে হক ও বাতিলের পার্থক্য করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ দিবসটিকে “ইয়াওমুল ফুরকান” তথা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণের দিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। রদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিল, রাসূলুল্লাহ (সা.) সংবাদ পান যে, আবু সুফিয়ান কুরাইশ কাফিরদের একটি বাণিজ্য দল নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কা ফিরছে। তিনি সাহাবিদের নির্দেশ দেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলার গতি রোধে বের হতে। কেননা কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কাফির কুরাইশরা মুসলিমদের তাদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ থেকে বের করে দিয়েছিল। অবস্থান নিয়েছিল ইসলামের সত্যবাণীর দাওয়াতের বিরুদ্ধে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ৩১০-এর বেশি কিছু সাহাবিকে নিয়ে বদর অভিমুখে রওনা হন। তাদের ছিল কেবল দুইটি ঘোড়া ও ৭০টি উট, যাতে তারা পালাক্রমে চড়ছিলেন। এ যুদ্ধে ৭০ জন মুহাজির এবং অন্যরা আনসার মুজাহিদ ছিলেন। তারা বাণিজ্য কাফেলা ধরতে চেয়েছিলেন, যুদ্ধ করতে চাননি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অনির্ধারিত সময়ে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম ও শত্রুদের মাঝে মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আবু সুফিয়ান মুসলিমদের অবস্থা জানতে পেরে কুরাইশদের কাছে এ মর্মে একজন চিৎকারকারী সংবাদবাহক পাঠায়, যেন কুরাইশরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। তাই আবু সুফিয়ান রাস্তা পরিবর্তন করে সমূদ্র উপকূল ধরে রওনা দিল এবং নিরাপদে পৌঁছে গেল। কিন্তু কুরাইশ সম্প্রদায় তাদের কাছে চিৎকারকারীর মাধ্যমে সংবাদ পৌঁছামাত্রই তাদের নেতৃস্থানীয় ১ হাজার লোক সদলবলে যুদ্ধের উদ্দেশে রওনা দিল। তাদের ছিল ১০০টি অশ্ব ও ৭০০ উট। আল্লাহ বলেন, তারা বের হয়েছিল, ‘অহঙ্কার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে বাধা প্রদান করতে।’ (সুরা আনফাল : ৪৭)। রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহর সৈন্যদল সাহাবীদের সঙ্গে নিয়ে চললেন এবং বদর কূপগুলোর কাছের পানির কূপের সম্মুখে যাত্রাবিরতি দিলেন। মুসলিমরা যুদ্ধের মাঠে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্য উঁচু স্থানে একটি তাঁবু বানালেন, যেখান থেকে যুদ্ধের ময়দান দেখা যায়। তিঁনি সেখানে অবস্থান করেছিলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) সেখান থেকে নামলেন, সাহাবিদের কাতার সুন্দর করে সাজালেন, যুদ্ধের ময়দানে চলতে থাকলেন এবং মুশরিকদের পতনের স্থল ও হত্যার স্থানগুলোর দিকে ইঙ্গিত করতে থাকলেন। অতঃপর দুইটি দল (মুসলিম ও কাফির) পরস্পর মুখোমুখি হলো। যুদ্ধ চলতে থাকল রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁবুতে অবস্থান করলেন। তার সঙ্গে ছিলেন আবু বকর (রা.) ও সা’দ ইবন মু’আয (রা.)। তারা দুইজনই রাসুলুল্লাহ (সা.)কে পাহারা দিচ্ছিলেন। তিনি মুসলিম যোদ্ধাদের যুদ্ধের প্রতি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘ওই সত্তার শপথ! যার হাতে মোহাম্মদের প্রাণ, আজ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে,ধৈর্য ধারণ করে সওয়াবের আশায় সামনে অগ্রসর হয়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন না করে যুদ্ধ করে মারা যাবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।’ (মুসলিম ) রাসুলুল্লাহ (সা.) একমুষ্টি মাটি বা পাথর নিয়ে কাফির দলের প্রতি ছুড়ে মারলেন। রাসুলের নিক্ষিপ্ত পাথর তাদের সবার চোখে বিদ্ধ হলো। তাদের সবার চোখেই সেটা পূর্ণ করে দিল, তারা তাদের চোখের মাটি ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল- যা ছিল আল্লাহর নিদর্শনগুলোর একটি নিদর্শন। ফলে মুশরিক সৈন্যদের পরাজয় হলো এবং তারা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে পৃষ্ঠদেশ প্রদর্শন করে পলায়ন করল। আর মুসলিমরা তাদের পিছু নিয়ে তাদের হত্যা ও বন্দি করা অব্যাহত রাখল। এভাবে তাদের ৭০ জন কাফির নিহত ও ৭০ জন বন্দি হলো। বদরযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম তথা মুসলমানদের বিজয়ের ধারা সূচিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মায়াজ ও মুআজ এর প্রতিশোধ : এ যুদ্ধে ২ জন আনসার কিশোর সহোদর হযরত মাআজ (রা.) ও হযরত মুআজ (রা.) ইসলাম ও বিশ্বনবীর সবচেয়ে বড় শত্রু নবীর চাচা আবু জেহেলকে হত্যা করেন। সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসাউদ (রা.) আবু জেহেলের মাথা কেটে বিশ্বনবী হয়রত মুহাম্মদ সা: কাছে হাজির করেন।
যুদ্ধের ফলাফল : মুসলমানেরা বিজয়ী। সফলতা : আত্মবিশ্বাস/বিজয়ের সূচনা/ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন/নবযুগের সূচনা/কাফিরদের শক্তি খর্ব/ইতিহাস সৃষ্টি/আল্লাহর গায়েবী সাহায্য ও ওয়াদা পূরণ/সত্যমিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি/চুড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি স্থাপনই বদর দিবসের প্রধান সফলতা। মুলত কাফিরদের ১০০০ অত্যাধুনিক সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন সাহাবী নিয়ে বিশ্বনবী সেদিন মহান রবের সাহায়্যেই বিজয় অর্জন করেন। যেটা আল্লাহর ওয়াদা ছিলো। আল্লাহ্ বলেন, “নিশ্চয় দুটি দলের মুকাবিলার মধ্যে ছিল তোমাদের জন্য নিদর্শন। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে আর অপর দল ছিল কাফেরদের। এরা স্বচক্ষে তাদেরকে দ্বিগুণ দেখেছিল। ” (সূরা আল ইমরানঃ ১৩)
শিক্ষা : মুলত দ্বীনের পথে বিজয়ী হতে সংখ্যা বা শক্তি নয়। প্রয়োজন তাক্বওয়া, ইমান। তাহলে আল্লাহর সাহায্য আসবে। আর আল্লাহর সাহায্য আসলে বিজয় ঠেকানোর কেউ নেই। বদর বিজয় আমাদের সেই শিক্ষায় দেয়।-(৪)
আব্দুল আলিম মোল্যা
রেকর্ড কিপার
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত
সাতক্ষীরা।