হাবিবুর রহমান: আজ ১৮ রমজান। গতকাল আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিল ১৭ রমজান।দিনটি ছিল ঐতিহাসিক ‘বদর দিবস’। যা ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে বা ২য় হিজরির ১৭ রমজান বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়। বদর মুমিনের প্রেরণা, চলার পাথেয় এমনকি বিজয়ের প্রাকটিক্যাল পথ। ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের এই দিনটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদরের যুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষার্থে, সত্যের পক্ষে, ইসলামের পক্ষে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের পক্ষে এবং মানবকল্যান নিশ্চিতের জন্য। এই যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়, সেজন্যই এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, “সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসারিত হয়েছে, আর মিথ্যা তো অপসারিত হওয়ারই কথা”। (সূরা বনি ইসরাইল: ৮১)
বদর যুদ্ধে কাফেরদের সজ্জিত এক হাজার দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ছিল ২০০টি ঘোড়া। অপরপক্ষে নিরস্ত্র মুসলমানগণ ছিলেন ৩১৩ জন সাথে ছিল ২টি ঘোড়া ও ৭০টি উট। তরবারির সংখ্যা ছিল নগন্য। তিনগুণ বেশি সুসজ্জিত কাফেরবাসীর বিরুদ্ধে বিজয় সত্যি বিস্ময়কর। এই দিনকে ‘ইয়াওমূল ফুরক্বান’ বলা হয়েছে।
ইসলামের শত্রুরা ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “এ লোকেরা মুখের ফুঁৎকারেই আল্লাহর নূর নিভিয়ে দিতে চায়; অথচ আল্লাহ তাঁর এ নূর পরিপূর্ণ করে দিতে চান। তা কাফিরদের কাছে যতই অপছন্দ হোক না কেন।” (সূরা সাফ : ০৮) আজকের যুগেও যারা ইসলামের আলোকে নিভিয়ে দিতে চায় এ আয়াত থেকে দারুন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।
যুদ্ধ শুরু হবার পরে যখন তীব্র যুদ্ধ চলছে, তখন হজরত আবু বকর (রা.) দেখতে পেলেন, মহানবী (সা.) ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন, আর আল্লাহর দরবারে বলছেন : ‘হে আল্লাহ! হাতেগোনা মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই দুনিয়ার বুকে ইবাদতের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আপনার সেই সাহায্য অবতরণ করুন, যা দেওয়ার অঙ্গীকার আপনি আমার সঙ্গে করেছেন।’ রাসূল (সা.) এর এই দোয়ার পরেই আল্লাহ আয়াত নাযিল করে বলেন- “যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দুআ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী”। (সূরা আনফাল : ৯) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং সতর্ক থাকো, তবে তারা আকস্মিক তোমাদের ওপর হামলা করলে আল্লাহ তাআলা পাঁচ হাজার ফেরেশতা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন”। (সূরা আলে ইমরান : ১২৫) “যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদেরকে যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। অচিরেই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব”। (সূরা আনফাল : ১২)
অতঃপর যুদ্ধে আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুত সাহায্য আসে এবং বদরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার অর্থাৎ ১৪ জন শহীদ হন। অন্যদিকে কাফেরদের পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। এটি ছিল অলৌকিক বিজয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : “তোমরা (মুসলমানরা) তাদের হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছেন।” (সূরা আনফাল : ১৭) বদরের বিজয়ের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার”। (সূরা আলে ইমরান : ১২৩)
মুসলিম উম্মাহর যখনই বিপর্যয় এসেছে বদরের পথ থেকে বিচ্যুতি হওয়ার জন্যই এসেছে। মুসলিম উম্মাহ আজ নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত হচ্ছে। আরাকান, কাশ্মীর, উইঘুর, ফিলিস্তিন, সিরিয়াসহ গোটা পৃথিবী আজ মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত! এই দুঃসময়ে মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়াবার সময় এসেছে। তার জন্য প্রয়োজন আরও একটি বদরের। মুসলমানরা বদরের পথ ধরেই বিজয়ের পথে হেঁটেছে এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আর সেই পথই রাসূল (সা.) আমাদের দেখিয়ে গেছেন।
ইতিহাস সাক্ষী মুসলিমরা কাফিরদের চেয়ে কখনও সমর শক্তিতে শক্তিশালী ছিল না। যখনই আল্লাহর ওপর ভরসা করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তখনই বিজয় তাদের পদচুম্বন করেছে। তাইতো আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা ত্বালাক: ৩)
“আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাহায্য করলে তোমাদের ওপর জয়ী হওয়ার কেউই থাকবে না”। (সূরা আলে ইমরান: ১৬০)
লেখক :
হাবিবুর রহমান
কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক