পঁচিশ পয়সা চাঁদার পাঠাগার, এখন একটি স্বপ্নের গল্প

মোঃ রুহুল আমিন( চৌগাছা) যশোর,প্রতিনিধিঃ যশোরের চৌগাছায় নেই কোনো বিদ্যুৎ, একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাটু সমান কাঁদা। আশপাশে ৫থেকে ৭ কিলোমিটারের মধ্যে নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১২থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে আছে একটি কলেজ। এর মধ্যে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে চলেছে উপজেলার বাড়ীয়ালী গ্রামের “বাড়ীয়ালী ‍যুব পাঠাগার”।

পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা জিলহজ আলী ওরফে নাসির হেলাল বলেন,১৯৭৭ সালের ৩০ মে, তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেলো এলাকায় শিক্ষা-বিস্তারের জন্য পাঠাগার স্থাপন করা যায় কিনা? যে চিন্তা, সেই কাজ। পাঠাগারটির নাম দেওয়া হলো বাড়ীয়ালী যুব কিশোর পাঠাগার ও সমাজ কল্যাণ সজাগ সমিতি। ১২ জন সদস্য জোগাড় করা হলো। যারা সবাই ছিলো শিশু। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। আমিসহ মোট সদস্য ১৩ জন। চাঁদা নির্ধারণ করা হলো ২৫ পঁয়সা করে। ১৩ জনের কাছ থেকে মোট চাঁদা উঠলো ৩.২৫ টাকা (তিন টাকা পঁচিশ পয়সা)। এত অল্প টাকায় তো আর পাঠাগার স্থাপন করা সম্ভব নয়! তাহলে কী করা যায়? সিদ্ধান্ত হলো এ টাকা দিয়ে মাছ চাষ করতে হবে। পুকুর কোথায় পাওয়া যায়? পুকুরও পাওয়া গেল। আমাদের মাছ চাষের জন্য স্বেচ্ছায় পুকুর দিলেন নওসার চাচা। চাষ করা হলো মাছ। কিন্তু মাছ বাড়ল না। মাছ চাষে লস। কি করা যায়! হেরে গেলে চলবে না।

আমাদের পাঠাগার তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গ্রামের তৎকালীন মেম্বর দিদার বক্স লস দিয়ে মাছগুলো ৬৫ টাকা দিয়ে কিনে নিলেন। মোট মূলধন এখন ৬৫ টাকা। এবার প্রত্যেক সদস্য বাড়ি থেকে একটি করে মুরগি দিল। ১৩টি মুরগি নিয়ে তৈরি করা হলো মুরগির ফার্ম। সেই মুরগি থেকে আমাদের মূলধন দাঁড়ায় ৩৫০ টাকা। আর গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয় ২৫টি বই। আমার নিজের একটা আলমারি। পাশের বাড়ি রুহুল আমিন চাচার বৈঠকখানায় শুরু হয় আমাদের পাঠাগার।

তিনি আরো বলেন, ১৯৮০ সালে যশোর পাবলিক লাইব্রেরী শর্ত সাপেক্ষে আমাদের ৫০টি বই ধার দেয়। পরবর্তীতে ইরান কালচারাল সেন্টার কিছু বই প্রদান করে। পাঠাগারটির রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করলে তৎকালীন যশোরের এডিসি (শিক্ষা) অডিটে আসেন এবং আমাদের আগ্রহ দেখে খুশি হয়ে ৫০০ টাকা দেন। কিন্তু পাঠাগারটির রেজিস্ট্রেশন নিতে গিয়ে শুরু হয় বিড়ম্বনা। সদস্যরা সবাই শিশু হওয়ার কারণে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছিল না। এরপর গ্রামের কিছু নতুন প্রাপ্ত বয়স্ক লোককে সদস্য নেওয়া হয়। ০৫ শতাংশ জমি দান করেন জিলহজ আলীর পিতা নাসির উদ্দিন বিশ্বাস, বড় ভাই নজরুল ইসলাম ও ষষ্ঠ ভাই নূরুল ইসলাম। ১৯৮২ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর খুলনা কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে। রেজিস্ট্রেশনের সময় নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখা হয় বাড়ীয়ালী ‍যুব পাঠাগার। জমি দাতা নূরুল ইসলাম জানান, পাঠাগারটি রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর এটি পরিদর্শন করেন তখনকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসাইন। একটি বৈঠকখানায় পাঠাগারটি ৮ বছর থাকার পর স্থানান্তর করা হয় প্রতিষ্ঠাতার নিজ বাড়িতে। ১৯৮৩ সালে পাঠাগারটি নিজস্ব জমিতে পাকা ঘর নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীর সহযোগিতায় ইটের পাজায় ১০,০০০ হাজার ইট তৈরি করা হয়। এরশাদ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় ৩৫,০০০ হাজার টাকার বই ও ৩৫,০০০ টাকা নগদ প্রদান করেন। ১৯৮৫ সালে প্রথম নিজস্ব জমিতে পাঠাগারটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন গ্রামের নওসার আলী। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে সে সময়কার সরকার কিছু আর্থিক অনুদান ও বই প্রদান করে। সেই অর্থ দিয়ে ১৯৯৪ সালে পাঠাগারটি আধাপাকা নিজস্ব ভবন তৈরি হয়।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যশোর-চৌগাছা মেইন রোড থেকে ৩.৫ কিলোমিটার ও চৌগাছা-ঝিকরগাছা রোড থেকে ২ কিলোমিটার দূরে গ্রামের প্রায় মধ্যবর্তীস্থানে মেইন রোডের সাথে পাঠাগারটি অবস্থিত। গ্রামে এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে, আছে পিচ ঢালা রাস্তা ও বিদ্যুৎ। পাঠাগারটি প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যান্ত খোলা থাকে।

পাঠাগারটির খণ্ডকালীন গ্রন্থাগারিক মোঃ জুবায়ের হোসেনের জানান, ২০১১ সালে যশোর জেলা গণগ্রন্থাগার কর্তৃক গ্রামীণ পাঠাগারের এক নম্বর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে এ পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের মতো। বইগুলো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠাতা জিলহজ আলীর নিজের চাকরির টাকার একটি অংশ দিয়ে কেনা। যতসামান্য কিছু বই সরকার থেকে অনুদান পাওয়া যায় যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। পর্যাপ্ত পরিমাণে তাক না থাকায় অনেক বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পরপর দু’বছর কালবৈশাখী ঝড়ে পাঠাগারটির চাল উড়ে গিয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মোঃ রবিউল ইসলাম ও মোঃ মমিনুর রহমান পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা তারা বলেন, আমরা এ পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক ছিলেন। রবিউল ইসলাম পটুয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ১৫তম ব্যাচের ছাত্র ও মমিনুর রহমান একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ বিভাগের ছাত্র। আমরা যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন পাঠাগারটি সম্পর্কে জানতে পারি। আমরা এখানকার নিয়মিত পাঠক ছিলাম। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার কারণে বাড়িতে থাকতে পারি না। তবে যখনই বাড়িতে আসি তখন একবার হলেও পাঠাগারটিতে এসে বই পড়ি। কারণ বিভিন্ন বিষয়ের উপর এখানে প্রচুর পরিমাণে বই আছে। আমাদের অনেক গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকলেও বই কিনে পড়া অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে পড়তে এলে কোনো শর্ত, টাকা পয়সা বা সদস্য হওয়া লাগে না। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো ব্যক্তি এসে বই পড়তে পারেন। এটা সবার জন্য উন্মুক্ত। তাছাড়া এখান থেকে বই পড়ে আমরা অনেক তথ্য জানতে পারি। যেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেক কাজে লাগে।

গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত ও প্রবীণ একজন পাঠক আঃ সামাদ (৬০) জানান, কুরআন, হাদীস, মাসালা-মাসায়েল সম্পর্কে জানার জন্য তিনি নিয়মিত এ পাঠাগারে আসেন।

স্থানীয়ারা জানান, এই পাঠাগারটির যথেষ্ঠ সুনাম রয়েছে। পাঠাগারটিতে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩৯ জন। ২০০৪ সাল থেকে এখানে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে মাস্টার্স শ্রেণি পর্যন্ত কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদে

Check Also

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করেননি সমাজী

জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।