ক্রাইমবাতা রিপোটঃ সাতক্ষীরা : ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ প্রবল শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসায় উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে সরকার।
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট আম্ফানের প্রভাবে দেশের ২০ জেলার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যেতে পারে। এসব জেলার ২১ লাখ মানুষকে নিজ বসতবাড়ি থেকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসা হবে। এছাড়া আম্ফানের তাণ্ডব থেকে রক্ষায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সবার ছুটি বাতিল করা হয়েছে বলে সরকার জানিয়েছে। এদিকে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সোমবার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান সোমবার সচিবালয় থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ প্রবল শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলের দিকে ধেয়ে আসায় উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১২ হাজার ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছে সরকার।
সোমবার রাতের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়টি সুপার সাইক্লোনের রূপ নিতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৫১ লাখ ৯০ হাজার ১৪৪ জন মানুষকে আশ্রয় দেয়া যাবে।
কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট হওয়ায় সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করা হবে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে সবাইকে নিরাপদে রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আসবেন, তাদের সবাইকে মাস্ক পরে আসতে বলা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনতে কাজ শুরু করেছেন।
মঙ্গলবার রাতের মধ্যে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হবে জানিয়ে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ২ হাজার ৫৬০ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন।
একটি মানুষকেও যাতে প্রাণ হারাতে না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি। যেসব মানুষ ঝুঁকিতে আছেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হবে।
অন্য যে কোনো দুর্যোগ থেকে এবার সব থেকে বেশি সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ বাংলাদেশ উপকূলের হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসার পর সমুদ্র বন্দরগুলোকে বিপদ সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে এ ঘূর্ণিঝড় খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন, তাদের জন্য ৩ হাজার ১০০ টন চাল, ৫০ লাখ নগদ টাকা, শিশু খাদ্য কিনতে ৩১ লাখ টাকা এবং গোখাদ্য কিনতে ২৮ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। এছাড়া ৪ হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার পাঠানো হয়েছে উপকূলীয় জেলাগুলোতে। সিভিল সার্জনদের নেতেৃত্বে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধসহ ওইসব টিম প্রস্তুত রয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ গেলে বিকল্প ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এলজিইডিকে বলা হয়েছে, যেসব অঞ্চলের লোকজনদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হবে, সেসব অঞ্চলের সড়ক এবং ব্রিজে কোনো সমস্যা হলে জরুরিভত্তিতে তা মেরামত করতে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কোনো বাঁধ ভেঙে গেলে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে তা মেরামত করে দেবে বলেও জানান এনামুর।
ছুটি বাতিলসহ কর্মস্থলে অবস্থানের নির্দেশ
পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বলেছেন, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবিলায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। ঝড়টি বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলো থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে আছে। এটি আরো ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা আছে। সমুদ্রবন্দর এলাকাসমূহের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় দিকনিদের্শনা দেয়া হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের অনুরোধ করছি।
সোমবার চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, মোংলা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনাসহ বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় প্রশাসন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় যারা ছুটিতে আছেন, তাদের ছুটি বাতিলসহ কর্মস্থলে অবস্থান ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠা-নামা বন্ধ
প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সোমবার বিকালে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নিজস্ব সংকেত ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়েছে। এই সতর্কতার পদক্ষেপ হিসেবে বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। পণ্যবাহী জাহাজগুলো জেটি থেকে সমুদ্রে পাঠানো হচ্ছে। সোমবার বন্দর সচিব ওমর ফারুক এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, বিকেলে আবহাওয়া অফিস থেকে ৬ নম্বর সিগনাল জারির পর অ্যালার্ট-৩ জারির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরপরই জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। জেটি থেকে পালাক্রমে জাহাজ সাগরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জেটিতে থাকা জাহাজে ব্যাপক আঘাত লাগে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে জাহাজ জেটি থেকে কিছুটা দূরে সাগরে পাঠানো হচ্ছে।
তিনি জানান- কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজারসহ বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজ রয়েছে ১৬০টি। বন্দর জেটিতে অবস্থান করছে ১৫টি জাহাজ। দুপুরে দুটি জাহাজকে গভীর সাগরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গভীর সাগরে অবস্থানরত সব জাহাজকে সার্বক্ষণিক ইঞ্জিন সচল রাখার এবং গভীর সাগরে নিরাপদ অবস্থানে চলে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর সচিব বলেন, যেসব ছোট লাইটরেজ জাহাজের মাধ্যমে বহির্নোঙর থাকা বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হয়, সেসব জাহাজকে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর উজানে গিয়ে নোঙর করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করছে কোস্টগার্ড পূর্বাঞ্চল।
এদিকে সোমবার বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে দক্ষিণপূর্ব বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণপশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থান করছে। এটি ক্রমান্বয়ে ঘণীভূত হয়ে উত্তর-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে ১৯শে মে (মঙ্গলবার) শেষরাত থেকে ২০শে মে (বুধবার) বিকাল অথবা সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
যেসব জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যেতে পারে আম্ফান
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ এবং চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে