ঈদের নামাজ ঘরে পড়া জায়েজ কি না

ক্রাইমর্বাতা রিপোট:  ঈদ মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎসব। ঈদে নামাজ পালনের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়। কিন্তু এবারের মতো ঈদুল ফিতর আর কখনো আসেনি। সাধারণত ঈদ জামাত হয় খোলা মাঠে। ঈদগাহে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে বিশ্বের দেশে দেশে ঈদ জামাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কথা বলা হয়েছে। ঈদের জামাত খোলা ময়দানে পড়ায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। মসজিদে পড়তে বলা হয়েছে।

কিন্তু ঈদগাহে জামাত আদায় যেহেতু বন্ধ, মসজিদেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজ আদায় করতে গেলেও অনেকে নামাজে অংশ নিতে পারবেন না। একাধিক জামাত হলেও কেউ কেউ বাদ পড়বেন। এ অবস্থায় কি করা যায়? ঘরে নামাজ পড়লে কি ঈদের সালাত আদায় হবে? নাকি ঘরে পড়া যাবেনা। এ প্রশ্ন এখন সামনে এসছে। এ ব্যাপারে জামিয়া মোহাম্মদিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুরের শায়খুল হাদিস, বাংলাদেশ মুফতি বোর্ড ফাউন্ডেশনের মহাসচিব, শায়খুল হাদিস, আল্লামা মুফতি শামসুল আলম বলেন, সবার আগে জানতে হবে ঈদের নামাজের বিধান কি? বিশেষ করে আমরা যারা হানাফী মত অনুসরণ করি, হানাফী মত অনুযায়ী ঈদের নামাজ ওয়াজিব। ঈদের নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। যেখানে, যেভাবে জুমার নামাজ আদায় করা সহীহ হয়, সেখানে ঈদের নামাজও সহীহ হবে। জুমা ও ঈদের নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য অন্যতম শর্ত হলো- ইজমে আম( সাধারণ অনুমতি থাকা) তথা কারো জন্য যেখানে ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হবে সেখানে আসতে কোন রকম বাধা নিষেধ না থাকা। শরীয়তের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈদের নামাজ উন্মুক্ত স্থানে হওয়া। লকডাউন, মহামারী বা কোন পরিস্থিতির কারণে যদি উন্মুক্ত স্থান বা ঈদগাহে যদি নামাজ পড়া সম্ভব না হয় তাহলে দ্বিতীয় হলো মসজিদে নামাজ আদায়। তৃতীয় হলো বাসায়। তবে যেখানে এক ফ্যামেলি নয়, একাধিক ফ্যামেলির লোক জমায়েত হয়ে নামাজ অাদায় করবেন। যদি অন্যদেরকে আসতে বাধা দেয়া হয় তাহলে বাসায় ঈদের সালাত আদায় হবে না। তারপরও কেউ যদি আদায় করতে না পারেন তাহলে তিনি সালাতুজ জোহা জোহা আদায় করে নেবেন। সালাতুজ মুস্তাহাব নামাজ দুই অথবা চার রাকাত নামাজ পড়তে হবে। তিনি বলেন, ঈদের নামাজের অন্যতম আরেকটি শর্ত হলো- জামাত হওয়া। ইমাম ব্যাতিত নিম্নে তিজন ব্যক্তি থাকতে হবে।
অপরদিকে দুদিন আগে মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী এ ব্যাপারে ফেসবুক লাইভে বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেন। বলেন, এটা নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন ও অনেক আলোচনা হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশের স্কলাররা বা যে ফতুয়া বোর্ডগুলো আছে তারা ব্যাপারটি নিয়ে গবেষণা করে ফতুয়া দিচ্ছেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারটি নিয়ে এতো আলোচনার কারন হচ্ছে আমরা এর আগে এমন পরিস্থির সম্মুখীন হইনি।
এবারের রমজান অন্য রমজান থেকে আলাদা, যার কারনে এবারের ঈদও অন্য রকম ভাবেই পালিত হবে। এবারের ঈদের নামাজের মাসায়ালাও আলাদা ।

আমাদের সবার আগে জানতে হবে ঈদের নামাজের হুকুম কী?
আমরা বছরে দুই বার ঈদ উদযাপন করি। একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আযহা। ঈদের নামাজের হুকুম কী? এক্ষেত্রে স্কলারদের মতভেদ রয়েছে। মালেকী ও শাফেয়ী মাজহাবে এই ঈদের সালাত কে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
আর হাম্বালী মাযহাব মতে এটি ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ এলাকার কিছু মানুষ যদি পালন করে তাহলে এলাকার অন্যদের আর পড়া লাগবে না।
হানাফী মাজহাব মতে ঈদের সালাত আদায় করা ওয়াজীব। শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম শাওকানী( র.) সহ অনেকেই এই মতামতকে গ্রহন করেছেন। তাদের মতে কেউ যদি এটাকে বাদ দেয় তাহলে সে গুনাহগার হবে।
এখন আমরা কোরআন সুন্নাহের দিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখবো যে অনেক গুরুত্বের সাথে এই সালাতের কথা বলা হয়েছে। সূরা কাউসারের ২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে ‘’ ফাছোয়াল্লি লিরব্বিকা ওয়ানহার” অর্থাৎ অতএব তোমার রবের উদ্দেশ্যেই সালাত পড় এবং নহর কর। যদিও এখানে ঈদুল আযহার কথা বলা হয়েছে যে তোমরা আগে সালাত আদায় কর এবং তারপর নহর করো। তাহলে এখানে আদেশ করা হয়েছে ঈদের সালাত আদায় করার জন্য। সহীহ বুখারীতে আমরা একটা হাদিস পাই,”হাজ্জাজ ইবনু মিনহাল (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে খুতবা দিতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, আমাদের আজকের এ দিনে আমরা যে কাজ প্রথম শুরু করব, তা হল সালাত আদায় করা। এরপর ফিরে আসব এবং কুরবানী করব। তাই যে এরূপ করে সে আমাদের রীতিনীতি সঠিকভাবে পালন করল। আরো বলেছেন নারীদের নিয়ে যেনো ঈদগাহে যাই। তারাও জেনো ঈদের আনন্দে সামিল হতে পারে। যদি কোন নারীর মাসিক চলাকালীন সময় ঈদ আসে তাহলে তাকে নিয়েও ঈদগাহে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহানবী (সাঃ)। এখন মাসিক চলাকালীন ময়ে নামাজ পড়া যাবে না, কোরআন ধরা যাবে না। তাহলে তারা কেনো যাবে। এ প্রসঙ্গে নবী(সাঃ) বলেছেন তারা যাবে জেনো তারা এই কল্যানের সাথে শরীক হতে পারে, আনন্দ জেনো ভাগাভাগি করে নিতে পারে। তারা ঈদগাহে ঢুকবে না, তারা বাহিরে থাকবে এবং মুসল্লিদের দোয়ায় শরীক হবে।
উম্মে আতিয়া (রাঃ) নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, যে সকল নারীর পর্যাপ্ত জামা বা ওড়না নেই তারা কী করবে? উত্তরে নবী (সাঃ) বলেন, তারা জেনো অন্য যে বোনের ২টা জামা বা ওড়না আছে তাদের থেকে নেয় এবং ঈদগাহে যায়।
এ থেকে বুঝা যায় নবী (সঃ) ঈদের নামাজের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই লকডাউনে যদি মসজিদে কোন কারনে নামাজ পড়া যায়নি, ঈদগাহেও নামাজ বন্ধ, তাহলে ঘরে নামাজ পড়তে পারবো কি না?
এর উত্তরে আগে আমাদের জানতে হবে যে,যখন পরিস্থিতি স্বভাবিক ছিল তখন যদি কেউ ঈদের সালাত কারন বশত ছেড়ে দিতো তাহলে কি সে পরবর্তীতে একা একা ঈদের নামাজ আদায় করতে পারবে কি না।
এ নিয়ে ২ টি মতামত রয়েছে। প্রথম মতটা শাফেয়ী, হাম্বালী, মালেকী ও বেশির ভাগ স্কলারদের মত। এ মতামতে বলা হয়েছে কেউ যদি মসজিদে বা ঈদগাহে জামায়তে ঈদের সালাত মিস করে তাহলে সে বাসায় একা একা ঈদের সালাত পড়তে পারবে।
কিন্তু ২য় মত অর্থাৎ হানাফী মত অনুযায়ী কেউ যদি মসজিদে বা ঈদগাহে ঈদের সালাত পড়তে না পাড়ে তাহলে তার আর ঈদের সালাত পড়া লাগবে না। তার মতে ঈদের সালাত একটা সামাজিক ইবাদত। জুমআর সালাতের যে শর্ত ঈদের সালাতের একই শর্ত। অর্থাৎ কেউ জুমআর সালাত পড়তে না পারলে সে ঘরে যোহরের ৪ রাকাত সালাত আদায় করবে তেমনি ঈদের সালাত পড়তে না পারলে ঘরে ২ রাকাত বা ৪ রাকাত চাশতের সালাত আদায় করতে পারবে।
শাফেয়ী, হাম্বালী, মালেকীর মত বড় বড় স্কলাররা একাকী ঈদের সালাত আদায় নিয়ে একটি শক্ত দলিল পেশ করেছেন যা বুখারী শরীফের সহিহ হাদিস। এই হাদিসে প্রসঙ্গ ছিলো আনাস (রাঃ) কে নিয়ে। উনি উনার শেষ জীবনে ইরাকের বসরা নগরীতে থাকতেন। একদিন কোন কারণ বসত উনি এবং উনার পরিবার ঈদের নামাজ জামায়াতে পরতে পারেননি। যার ফলে উনি বাসায় এসে উনার পরবারকে নিয়ে ঈদের সালাত ঘরেই আদায় করে নেন।
এই হাদিস টি সহিহ ভাবে বুখারীতে এসেছে। “ কোন এক সময় যখন আনাস (রাঃ) এর ঈদের সালাত ঈদগাহে জামায়াতের সাথে ফাওত হয় গেলো তখন তিনি বাড়িতে এসে উনার পরিবার ও উনার আজাদকৃত সকল দাস দাসী কে একত্রিত করলেন। তখন উনার আজাদকৃত দাস আবূ উতবাকে বললেন, তুমি আমাদেরকে নিয়ে ঈদের সালাতের ইমামতী কর। তখন আবূ উতবা আনাস (রাঃ) সবাইকে নিয়ে ২ রাকাত ঈদের সালাত ঘরে আদায় করলেন। এবং প্রতি রাকাতেই অতিরিক্ত তাকবীর গুলো তিনি দিয়েছেন। এ হাদিস থেকে বলা যায় কেউ যদি ঈদের সালাত জামায়াতে মিস করে তাহলে সে ঘরে একাকী বা জামায়াতে ঈদের সালাত আদায় করতে পারবে। কেননা এটা মহানবী (সাঃ) এর খুব কাছের সাহাবী হযরত আনাস (রাঃ) এমনটি করেছেন, যাকে বলা হয় খাদেমু রাসুলুল্লাহ। তিনি ১০ বছর রাসুল (সঃ) এর খেদমত করেছেন। তিনি মহানবী (সঃ) এর চিন্তা, চেতনা সম্পর্কে খুব ভালো ধারনা রাখতেন এবং এর প্রেক্ষাপটেই উনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এই দলিলের আলোকে বেশির ভাগ স্কলাররা বলেছেন ঈদের নামাজ কারন বশত ঘরে পড়া যাবে।
যেহেতু আমাদের মসজিদ বন্ধ, আমরা ঈদগাহে যেয়ে নামাজ পড়তে পারছি না সেহেতু আমারা হযরত আনাস (রাঃ) এর সাথে কিয়াস করেই এর সমাধান খুজে নিতে হবে।
যেহেতু আমাদের কাছে মতামত ২ টি। একটি হল হানাফি মতামত, যেখানে বলা হয়েছে ঈদের সালাত সামাজিক ইবাদত সেহেতু এইটা ঘরে পড়া যাবে না।
অন্যদিকে বেশিরভাগ স্কলারের মতামত যে, কেউ মিস করলে সে ঘরে ঈদের সালাত আদায় করতে পারবে।
এই দীর্ঘসময়ের আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যেহেতু আরব বিশ্বসহ বেশির ভাগ মুসলিম দেশের ফতুয়া বোর্ডের মতামত অনুযায়ী আপনারা বাহিরে যেয়ে ঈদের সালাত আদায় করতে পারবেন না, সেহেতু আপনারা ঘরে ঈদের সালাত আদায় করুন। যেহেতু আনাস (রাঃ) এমনটি করেছেন সেহেতু আমরা চাইলে ঘরে একা একা বা সকলকে নিয়ে জামায়াতে ঈদের সালাত আদায় করতে পারবো।
হানাফি মাজহাব মতে ঘরে ঈদের সালাত আদায় করা যাবে না, কিন্তু এইটাও বলা হয় নি যে পরলে গুনাহ হবে। তাই আমরা ঘরে ঈদের সালাত আদায় করবো কেননা হানাফি মতে যদি এটা ঈদের সালাত নাও হয় তাহলে এই সালাত নফল সালাত হিসেবে গন্য হবে।

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।