প্রফেসর ড. আবদুল লতিফ মাসুম ।।‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। প্রতি বছরই এ দিনটি আমাদের মাঝে ফিরে আসে। ঈদ আসে আনন্দ ও আবেগের আহবান নিয়ে। কিন্তু কী সেই আনন্দ? প্রতিটি কাজের শেষে আমরা প্রতিদান পাই। আমরা যখন সমাপনী অনুষ্ঠান করি। পুরস্কার বিতরণী উৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমাদের কর্মসূচি। প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে বার্ষিক সভা হয়। বিভিন্ন নামের এসব সভায় যারা কৃতিত্বপূর্ণ ফল করে, তাদের সম্মানিত করা হয়। ঈদের দিন যেন এরকমই এক অনুষ্ঠান। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর, সিয়াম সাধনা শেষে এ দিন আসে। আল্লাহ রোজাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। বলেছেন, কষ্টকর এ ইবাদতের পুরস্কার নিজে সরাসরি দেবেন। এই ঈদের দিনটি বড়ই সম্মানিত দিন। এটি পুণ্যময় দিন। এটি অভিনন্দনের দিন। আসমানে এই দিনের নাম উপহার দিবস। অবশ্য এই সম্মান ও অভিনন্দন শুধু তাদের জন্য, যারা আল্লাহর আদেশে মাহে রমজানের এক মাস নিষ্ঠার সাথে সিয়াম বা রোজা পালন করেছেন। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরো এক মাস পবিত্র রমজান মাসের রোজা রাখার আদেশ অবতীর্ণ হয় যখন নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং সাহাবীরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন তার পরে। সেটা ছিল হিজরতেরও ১৮ মাস পরের ঘটনা। তখন আরবি শাবান মাস চলছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ নাজিল হয়, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোজা রাখবে।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। আজ ঈদুল ফিতর শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়, ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অনুষ্ঠান। রোজাদার বা বেরোজাদার সকল মুসলমানই এই দিনের আনন্দ-উৎসবে শরীক হয়। এটি অর্জন করেছে আনুষ্ঠানিকতা- প্রাতিষ্ঠানিকতা। পাশ্চাত্য কিংবা প্রাচ্যে, দেশে দেশে সকল রাজধানীতে মুসলিম কিংবা অমুসলিম সর্বত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়ে আসছে।
আজকের করোনা ভারাক্রান্ত বিশ্বে ঈদুল ফিতর এক বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে এসেছে। আজকে মহামারি আক্রান্ত সারা বিশ্ব। পৃথিবী যেন ‘লকডাউনে’ নিপতিত। ঘরবন্দী যেন পৃথিবী। একটা ভয়ঙ্কর সময় অতিক্রম করছে পৃথিবীর মানুষ। মিল্লাতে ইসলামিয়া মানবজাতির এক বিশাল অংশ হিসেবে আল্লাহর এ আজাবকে অতিক্রম করছে। ঈদুল ফিতরের নামাজ খোলা ময়দানে সম্মিলিতভাবে আদায় করার কথা। এটা প্রমাণ করে যে, ইসলাম ‘কালেকটিভ ইজম’ বা সমষ্টির ধর্ম। সর্বজনীন এর আবেদন। ইসলামের ‘ফরজ’ বা অপরিহার্য ইবাদতের শুরু প্রতিদিনের নামাজ দিয়ে। জামাত বা সমষ্টির সাথে বা সকলের সাথে এক হয়ে মসজিদে সম্পন্ন করার কথা। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিদিনের প্রতিটি জনপদের মিলন, মিশ্রণ ও মেলামেশা। এভাবে প্রতিটি পাড়া, মহল্লা ও গ্রাম শহরের লোকেরা একত্রিত হয়ে একে-অপরের খোঁজখবর নিতে পারে। প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার মুসলমানরা আর একটু পরিসরে একত্রিত হয়। পারস্পরিক আদান-প্রদান ও সম্প্রদান ঘটে এ সময়ে। বছরে দুইবার ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মাধ্যমে বিশ্বাসী মানুষ আরও বড় আয়তনে মিলিত হয়। এবার মসজিদে নয়। খোলা মাঠে। খোলা মনে। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, ক্ষমা ও ত্যাগের আহবান নিয়ে দুই ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে সহমর্মিতা, খোদাভীরুতা, দানশীলতা ও পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়ার দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ঈদের দিনে সুগন্ধি ব্যবহার মনের সুন্দর স্নিগ্ধতার প্রতীক। ঈদের দিনে একে-অপরকে খাওয়ানো সৌজন্য ও সম্প্রীতির প্রমাণ দেয়। একে-অপরের বাড়িতে যাওয়ার রেওয়াজটি অধিকতর মেলামেশা বা পারস্পরিক সম্পর্কের ইঙ্গিতবহ। হাদীসে আছে, ঈদের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক পথে যেতেন আর অন্য পথে ফিরে আসতেন। বেশি বেশি মানুষের সাথে দেখা হওয়াই এ হাদীসের তাৎপর্য। সুতরাং ঈদের দিনে শুধুই ঘরে বসে বসে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। কিছু লোক ঈদকে ভ‚রিভোজের পর্ব মনে করে। নিজে পেট পুরে খাওয়ার চেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর আনন্দ অনেক। ঈদের আদেশ ও আবেদন হচ্ছে, যারা খেতে পায় না, তাদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা। সেজন্যই রোজার মধ্যে এবং ঈদের নামাজের আগে ফিতরা আদায় করা অধিকতর সাওয়াবের কাজ। এছাড়া রোজার মধ্যে বেশি বেশি দান-সদকা করার কথা সকলেই জানেন। এসব কিছুই ইসলামের সর্বজনীনতা ও সমন্বয়ের প্রমাণ রাখে। সে এক সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। শত বছর ধরে এই তৌহিদী দীক্ষা কণ্ঠে ধারণ করে আছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। দুঃখের বিষয়, যে ঐক্য ও সংহতির আবেদন নিয়ে প্রতি বছর ঈদুল ফিতর আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়, তা আজ পরিত্যাজ্য।
জাগতিকভাবে প্রতিনিয়ত আমরা নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই। কাজ-কর্মে, আদান-প্রদানে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ও অফিস-আদালতে আমরা প্রতিদিন যে আচরণ লাভ করি, তা সবসময়ই সহজ-সরল ও স্বাভাবিক হয় না। অনেক বৈরিতা; এমনকি শত্রæতার মোকাবিলা করি আমরা। অফিসে কাজ করতে গেলে সহকর্মীর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ পেতে পারেন। ব্যবসা করতে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতে পারেন। এক আইলে জমি থাকলে ঝগড়া বাধতে পারে। প্রতিবেশীর সাথে দৈনন্দিন ব্যবহারে ও আদান-প্রদানে সমস্যা হতে পারে। এমনকি পরিবারে এবং নিকটজনের মধ্যে মতবিরোধ হতে পারে। ভাই-বোনে খিটিমিটি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সম্পর্ক বজায় রাখা বা পুনরুদ্ধারের একমাত্র সমাধান হলো ক্ষমার মনোভাব পোষণ করা। আর ঈদুল ফিতর হচ্ছে ইসলামী সমাজে সেই ক্ষমা ও মমত্বের একটি দিন। আল্লাহর তরফ থেকে এটি একটি সময় ও সুযোগ সবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। এদিন আপনাকে আসমানী তাগিদে অপরের জন্য ক্ষমার মনোভাব পোষণ করতে হবে। তাই আমাদের প্রিয় কবি নজরুলের আহবান, ‘আজ ভুলে যা তোর দোস্ত ও দুশমন হাত মিলাও হাতে’। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে এ আবেদন বাস্তব সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। যুদ্ধ নয়, শত্রæতা নয়, পারস্পরিক হানাহানি নয়, কবির আহবান কেবলমাত্র ‘প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ’। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনে মানুষের যেসব সিফাত বা গুণ অর্জন করা প্রয়োজন, তার মধ্যে ক্ষমা একটি অনিবার্য বিষয়। যদি আল্লাহ তার বান্দাদের ক্ষমা না করতেন, তাহলে দুনিয়ায় কোনো মানুষই রেহাই পেত না। এজন্য যে ব্যক্তি আল্লাহর গুণ ‘ক্ষমা’ অবলম্বন করে অপর মানুষের অপরাধ ক্ষমা করেন, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা যদি কল্যাণ কর প্রকাশ্যভাবে কিংবা গোপনে অথবা যদি তোমরা অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তাবে জেনে রেখ আল্লাহ নিজেও ক্ষমাকারী, মহাশক্তিমান। (সূরা নিসা : ১৪৯)। মানুষ যদি মানুষকে ক্ষমা করতে না পারে, তাহলে আল্লাহর কাছে সে কীভাবে ক্ষমার প্রার্থনা করতে পারে?
আজকের এই পবিত্র ঈদুল ফিতর যখন আমরা একটি মহাদুর্যোগের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছি, তখন আল্লাহ রাহমানুর রাহিম সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে আবারও কবি নজরুলের ভাষায় আমাদের বিনীত মোনাজাত, “দাও ভা’য়ে ভা’য়ে সেই মিলন, সেই দৃপ্ত মন/হোক বিশ্ব মুসলিম এক জামাত উড়ুক নিশান ফের যুক্ত চাঁদ”।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা।
ইমেইল : mal55ju@yahoo.com