আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্থদের দাবী ত্রান নয় চাই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান: সাতক্ষীরায় সবকিছু হারিয়ে দিশেহারা কয়েকলক্ষ মানুষ(ভিডিও)

আবু সাইদ বিশ্বাস:ক্রাইমর্বাতা রিপোট:সাতক্ষীরা:  উপকূলীয় অঞ্চল থেকে: দিনভর স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কার ও রাতে প্রবল জোয়ারে সেই বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দিন কাটছে সাতক্ষীরায় আম্ফানে ক্ষতি গ্রস্থ নদী অঞ্চলের মানুষ গুলো। বসত বাড়ি, সহায় সম্পত্তি হারিয়ে এসব মানুষ গুলো এখন দিশেহারা। আইলা ও সিডরে ও এত বড় ক্ষতির সম্মুখিন হয়নি তারা। ঘর-বাড়ি,মসজিদ-মাদ্রাসা,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , বাজার- ঘাট,অফিস সব যেন এখনো পানির নি”ে। মানুষ মারা গেলে কবর দেয়ার জায়গাটুকুও হারিয়েছে তারা। ভাঙ্গা-গড়া খেলার মধ্য দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলের প্রায় লক্ষাধীক মানুষের জীবন। সাতক্ষীরার দ্বীপ ইউনিয়ন আশাশুনির প্রতাপনগর ও শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন ঘুরে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিচ্ছিন্ন ত্রাণ সহায়তা দিয়ে দুর্যোগ কবলিত মানুষদের কেবল অথর্বই বানানো হয়েছে, সুপরিকল্পিত এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণজনিত ব্যর্থতায় প্রকৃতপক্ষে এসব মানুষের জীবন সংগ্রাম আরো তীব্র হয়ে ওঠেছে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার অধিক ক্ষতিগ্রস্থ আম্ফানে সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়ন।বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তায় বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতার কথা তুলে ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সরকারের কাছে এখন একটাই দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ আর কর্মসংস্থান।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, আম্ফানে সাতক্ষীরা জেলায় দুইজন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়েছে। ঝড়ে ২২ হাজার ৫১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৬০ হাজার ৯১৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রবল এই ঝড়ে সাতক্ষীরা উপকূলের নদ-নদীর অন্তত শতাধীক পয়েন্টে ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ৫৭ কিলোমিটার বেড়িবাধ ও এলজিইডির ৮১ কিলোমিটার রাস্তা। ঝড়ে সাতক্ষীরায় ৬৫ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা ৪০ হাজার টাকার আমসহ ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার কৃষি সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৬২ কোটি ১৬ লাখ টাকার সবজি, ১০ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকার পান ও সাড়ে ৪ লাখ টাকার তিল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকের সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৮৭০। ঝড়ে ৯১টি খামার ও ৬৪০টি গবাদি পশুসহ ১৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৩০ টাকার গবাদি পশু এবং ৮৬টি হাস মুরগির খামারসহ ৭৭ লাখ টাকা ৬৭ হাজার ৮৬ টাকার হাসমুরগির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে সাড়ে ১২ হাজার মৎস্য (চিংড়িসহ) ঘের। যার ক্ষতির পরিমান ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা টাকা।
ঘূর্ণিঝড়ে যতটা না ক্ষতি হয়েছে, বাঁধ ভেঙে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় মানুষের। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বাঁধ ভেঙে উপকূলের বুড়ি গোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগরের মানুষ জোয়ার-ভাটার মধ্যে বাস করছে। এজন্যই আবারও টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা
সরেজমিন দেখা গেছে, শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের নেববুনিয়া, বুড়ি গোয়ালিনীর দাতিনাখালি, পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা, বন্যতলা, কামালকাটি, কুটিকাটা প্রতাপনগর ইউনিয়নের দিঘলারাইট, কুড়িকাহুনিয়া, সুভদ্রাকাটি, হিজলিয়াকুলা,চাকলা, শ্রীউলা ইউনিয়নের মাড়িয়ালা ও খুলনার কয়রা এলাকার পানি উন্নয়ন বেড়িবাঁধের কোথাও ২ কিলোমিটার কোথাও ৫ কিলোমিটার ভেঙে নদীর পানি প্রবেশ করছে প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন এলাকা। এসব অঞ্চলের মানুষের ত্রাণ নয়, বাঁধ চায়। কিছু দিন পর পর নদীর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়ে সবকিছু হারাতে হচ্ছে তাদের।
আসলাম গাজী। চাকলা ২নং ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বর। তিনি বলেন, ‘এই এলাকা বসবাস করার মতো নেই। কিছু দিন পরপর বেড়িবাঁধ ভেঙে সব নিয়ে চলে যায়। খেটেখুটে মানুষ যা কিছু সঞ্চয় করে সেগুলো নতুন কোনও ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কিছুই রেখে যায় না। আমরা ওয়ার্ডের মানুষ কিছুই পায়না। না ত্রান না আর্থিক সহয়াতা। এর পরও তাদের দাবী সরকারের কাছে ত্রাণ চাই না। আমাদের কোনও কিছু দিতে হবে না। টেকসই বাঁধ নির্মাণ করুন, তাতেই আমরা খুশি।’
একই এলাকার আকবর আলী,আব্দুর রউফ,মোস্তাফিজুর রহমান,ছকিনা বেগম জানান,আমরা ত্রান চাই না আমরা বেড়ি বাঁধ চায়। যাতে আমরা কর্ম করে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি।
বুড়িগোয়ালিনী এলাকার ছমিরন বিবি বলেন, ‘এবার ঈদ আমাদের জন্য ছিল বেদনার। এখনো ঘরে পানি। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া হোক
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার উপকূলের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনে গেলে গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে দেওয়ার দাবি জানান।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, ‘আম্পানে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকা ও খুলনার কয়রার বেড়িবাঁধগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় মেরামত করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখে খুব কষ্ট লাগলো, মানুষ সব পানির মধ্যে বসবাস করছে। ঝড়ের আগে আমরা কাজ শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে কাজ শুরু করতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের কাছে শুনেছি তারা ত্রাণ চান না, টেকসই বেড়িবাঁধ চান। আমরাও তাদের টেকসই বাঁধের আশ্বাস দিয়েছি। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্থখুব খারাপ স্থানগুলো চিহ্নিত করে ছোট ছোট প্রজেক্ট নিয়ে বাঁধগুলো সুউচ্চ করে নির্মাণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপকূলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ডেলটা প্ল্যান ঘোষণা করেছেন। ২০৩০ সালের মধ্যে এই এলাকার জন্য এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। উপকূলের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাঁধ মেরামতের কাজ করেছি। কিন্তু জলোচ্ছ্বাস হলে তাতে করার কিছু থাকে না।
শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় ভেঙে যাওয়া ২৩টি পয়েন্টের বেড়ি বাঁধগুলো সংস্কারে স্থানীয় শত শত মানুষ প্রতিনিয়ত স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।জোয়ারের পানি ঠেকাতে এলাকাবাসীর প্রাণপণ এই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কালিগঞ্জের কালিকাপুরের পানিবন্দী অর্ধশত পরিবার ত্রাণ নয় পানি নিস্কাশনের দাবী জানিয়েছে। নিজ ঘরবাড়ি ফেলে অনেকেই রাস্তার ধারে, স্কুলে কিংবা অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে দুর্বিসহ সময় পার করছে অনেকে। শুক্রবার (২৯ মে) সকালে সরেজমিনে দেখাগেছে, ২০ মে থেকে অদ্যবধী উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের তালতলা হাট সংলগ্নে থেকে নদীর ধার পর্যন্ত ৫০/৫৫ টি পরিবার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের বসতঘর, রান্নাঘর, হাঁস, মুরগী আর গোয়ালঘরসহ গুরুত্বপুর্ণ সম্পদ পানিতে নিমজ্জিত। তাদের অভিযোগ, নদীর পানিতে প্লাবিত হওয়ার আজ দশদিন হয়ে গেল অথচ কেঊ খোঁজ নেয়নি। পাশে এসে অভয় দিয়ে পানিবন্দী থেকে মুক্ত করার কথা কেউ বলেনি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, শ্যামনগর উপজেলার গাবুরার লেবুবুনিয়া, কাশিমাড়ির কোলা ও বুড়িগোয়ালিনীর দাতিনাখালি বাদে সব পয়েন্টের বেড়িবাঁধগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় স্থানীয় জনতা রিংবাঁধ দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে সংস্কার করছেন।
গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাশ্রমে শত শত মানুষ বেড়িবাঁধ সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২ এর আওতাধীন আশাশুনি উপজেলার প্রতাাপনগর ইউনিয়নের ৩টি পয়েন্টে স্থানীয় জনতা স্বেচ্ছাশ্রমে রিংবাঁধ দিলেও বাকী ৫টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ এখনও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন।
ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, এভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তার দাবী তার ইউনিয়নে ৪০ কিলোমিটার অবদার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তিনি আরো জানান ৮টি ক্লোজারের অধীনে ১৪টি রিং বাধ দিলে গ্রামে পানি প্রবেশে ঠেকানো সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে তিনি ৩৫ লক্ষ টাকা অর্থবরাদ্ধ চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস.এম মোস্তফা কামাল জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় স্থানীয় জনতা বেড়িবাঁধগুলো রিংবাঁধ দিয়ে সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি পয়েন্টে রিংবাঁধ সম্পন্ন হয়েছে। খুব দ্রুতই বাকী পয়েন্টগুলোর বেড়িবাঁধ রিংবাঁধের মাধ্যমে সংস্কার সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।
উপকূলের বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শনে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন, সাতক্ষীরায় অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। করোনা পরিস্থিতির জন্য ৯শ’ ও ১২শ’ কোটি টাকার প্রকল্প থেমে আছে। এছাড়া সংস্কার কাজসহ প্রকল্পের কাজে সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হবে। এসময় তিনি জনগনের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন।

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।