উপকুলীয় অঞ্চল আশাশুনি,শ্যামনগর ও কয়রায় মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় (ভিডিও)

ক্রাইমর্বাতা রিপোট:সাতক্ষীরা:  ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। ঝড়ের আঘাতে মারা যাওয়া মুরগি, মাছ, পাখি, নানা প্রজাতির প্রাণীর লাশ পচে গলতে শুরু করেছে। সূর্যের তাপ বৃদ্ধির সঙ্গে চারপাশে বাড়ছে দুর্গন্ধ। দূষণের কারণে পানি ও বাতাস হয়ে উঠছে অসহনীয়। যা সিডর, আইলা ও বুলবুলকেও ছাড়িয়েছে। ফলে ঘটছে মানবিক ও পরিবেশ বিপর্যয়। এমন অবস্থার মধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে ১২ হাজার শিশু ও প্রতিবন্ধী। কয়রা এখন জোয়ারে ডোবে আর ভাটায় জেগে ওঠে। বাঁধ ভেঙে লোনা পানি প্রবেশ করায় কয়রার মিষ্টি পানির সব আধার। লোনা পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে গোটা এলাকা।

কয়রা, আশাশুনি ও শ্যামসগরের চারদিকে কেবল পানি আর পানি। থেকে থেকে কিছু গাছ-পালা উঁকি দিচ্ছে। যে রাস্তাগুলো ছিল মসৃণ ও সুদৃশ্য, সেগুলে নিচু জমির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যাতায়াত করতে স্থানীয়দের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ভাটায় পানি নেমে গেলে নৌকা নিয়ে চলাচলও করা যাচ্ছে না। ফলে মানুষকে কাদা পানি মারিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে। বাজারের দোকানগুলোর সামনে ব্যবসায়ীরা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছেন। কেউবা নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছেন। কোন দোকানের খুঁটির মাথায় কেবল চালা রয়েছে, ভেতরটা ফাঁকা। কোথাও দোকান ঘরের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অধিকাংশ বাড়ি-ঘরই জলাধার ও ধ্বসস্তুপে পরিণত। যে মাঠ ফসলের ক্ষেত, মাছের ঘের কৃষককে দোলা দিতো তা আজ কেবল স্মৃতি। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রসহ সমগ্র কয়রা জুড়েই চলছে সুপেয় পানির হাহাকার।

২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বরের সিডরের জলোচ্ছ্বাসের পর পানি দ্রুত নেমে গিয়েছিল। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার জলোচ্ছ্বাসের পানি নামেনি। জলাবদ্ধতার শিকার মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী। ২০১৯ সালের ১০ মে ফনী ও ১০ নবেম্বরের বুলবুলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু গত ২০ মে’র আম্পানের আঘাতে ক্ষয়ক্ষতি বিস্তর। সিডর-আইলা থেকেও আম্পানে ক্ষয়-ক্ষতির পার্থক্য বিস্তর। আইলায় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পানির চাপে বাধের যতটা না ক্ষতি ছিল, পানি নেমে যাওয়ার সময় বাঁধগুলোর ক্ষতি হয়েছে বেশি। আটকা পড়া পানির চাপে নতুন এলাকায় ভাঙন ধরে। টিকে থাকা বাড়ি-ঘর গুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয় নেমে যাচ্ছে পানির টানে। কিন্তু আম্পানের ৪ ঘণ্টাব্যাপী তান্ডবে বাঁধ, ঘর-বাড়ি সব তছনছ হয়ে যায়।

দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ৫২টি গ্রাম জুড়েই বিশুদ্ধ পানি নেই। অন্য ৩টি ইউনিয়নেরও অধিকাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত। ওসখানেও পানির সংকট তীব্র। আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া মানুষগুলো পানি না পেয়ে আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বেদকাশির হাজতখালী এলাকায় মানুষ খাবার পানির জন্য নদী পার হয়ে ওপার যায়। সেখান থেকে কলস ভরে পানি আনতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। কয়রা সদরের ২নং কয়রা এলাকা পনিতে তলিয়ে থাকায় মানুষ বাথরুম করছেন প্রকাশ্যে পানির মধ্যে। আর কোনও রকমে টিকে থাকা ঘরের মধ্যে খাটের ওপরই রান্না খাওয়া চলছে। পানি ভেঙেই কাজ-কর্ম করতে হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত নলকূপও অকেজো হয়ে গেছে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে ৩২ লিটারের পানির ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

হাজতখালী রিতা রানী বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলাম। কিন্তু খাবার পানি পাওয়া যায় না। তাই বাড়িতে চলে এসে দেখি ঘর নেই। এরপর এখানে মাথা উঁচু করে থাকা বাঁধের এইটুকু জয়গায় অবস্থান নেই। কোনও খাবার না পেলেও সমস্যা হয় না। কিন্তু সময়মতো খাবার পানি না পেলে চরম দুঃসহ অবস্থায় পড়তে হয়। তাই ভাঙনের কবলে থাকা এ কপোতাক্ষ পার হয়ে ওপারের নলকূপ থেকে কলস ভরে পানি আনতে হয়। যাওয়ার সময় খালি কলস নিয়ে যেতে সমস্যা হয় না। কিন্তু কলস ভরে পানি নিয়ে নদী পার হয়ে আসতে চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়। একটু এদিক-সেদিক হেলে গেলেই কলসে লোনা পানি ঢুকে কষ্ট করে আনা মিষ্টি পানিও নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’

কয়রা সদরের ২ নম্বর কয়রা গ্রামের রেশমা বেগম বলেন, ক্যান্সারে আক্রান্ত তার স্বামী আনসার সানা ১০ মাস আগে মারা গেছেন। তারপর থেকে ৩ ছেলে নিয়ে জীবনযাপন করছেন কষ্টের মধ্যে। এ অবস্থায় বুলবুলের আঘাতের ধাক্কা সামলে নিয়েছিলেন। কিন্তু আম্পানের আঘাতের ক্ষতি সামলে এগিয়ে চলা দুরূহ হচ্ছে। চারদিকে পানি থাকায় এদের একা রেখে তিনি আশপাশেও যেতে পারছেন না।

কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালা বলেন, কয়রা উপজেলায় ০-৫ বছর বয়সী প্রায় ২০ হাজার শিশু রয়েছে। আর আম্পানে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়ন এলাকাতে ০-৫ বছর বয়সী প্রায় ৯ হাজার শিশু রয়েছে। এ সব শিশু বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

তিনি বলেন, বন্যার পানিতে শিশু ভেসে যাওয়া, সাপে কাটা, ডায়রিয়া-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আম্পানের কারণে মাছ, পশু-পাখী মরে পানিতে পড়ে থাকার কারণে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই আক্রান্ত ৪টি ইউনিয়ন এলাকায় ১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখান থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের দিয়ে সব শিশুকে ডোর টু ডোর প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করা হচ্ছে।

কয়রা উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার অনিকেত বিশ্বাস বলেন, কয়রায় তালিকাভুক্ত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৯৯২ জন। এর মধ্যে ২৪০০ প্রতিবন্ধী নিয়মিত ভাতা পান। আম্পানের প্রভাবের কারণে প্রতিবন্ধীরা যাতায়াত সমস্যায় ভুগছেন। খাদ্য সমস্যায় রয়েছেন। পোশাক ও চিকিৎসা সমস্যায় পড়ছেন। আর এসব সমস্যায় প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়ার মত লোকজনও পাচ্ছেন না।

খুলনা জেলা সমাজসেবা উপ-পরিচালক খান মোতাহার রহমান জানান, কয়রায় ২৪০০ প্রতিবন্ধীকে ৭৫০ টাকা করে ভাতা। আর প্রাথমিকে ৯০০ টাকা ও উচ্চতর শিক্ষায় ১৩০০ টাকা উপবৃত্তি দেওয়া হয়। এছাড়া আম্পানের পর তাদেরকে কোনও ধরনের সহায়তা দেওয়া এখনও সম্ভব হয়নি।

কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিমুল কুমার সাহা বলেন, আম্পানের আঘাতের পর বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশু ও প্রতিবন্ধীরা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে সাধারণ ত্রাণের পাশাপাশি শিশু খাদ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। খাবার পানিরও সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, নদীর পানি অতিরিক্ত লবণ। তাই বিশুদ্ধ পানি পানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসন থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, আম্পানের প্রভাবে কয়রায় তাদের দেয়া ৯০০ নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে কয়রা সদরে দু’টি ভ্রাম্যমাণ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এ প্ল্যান্ট দু’টি দিয়ে লবণ পানিকে সুপেয় করা হচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় একটি প্ল্যান্ট দিয়ে ২ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

তিনি বলেন, চলাচলের পথ সক্রিয় না থাকায় প্রত্যন্ত এলাকায় এ প্ল্যান্ট নেওয়া যাচ্ছে না। তাই ২ হাজার ১০০ জেরিকেন সরবরাহ করা হযেছে। এর ফলে সদর থেকে বিশুদ্ধ পানি প্রশাসনের লোকজনই প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা সক্রিয় হলে প্রত্যন্ত এলাকায় আরও দু’টি ভ্রাম্যমাণ প্ল্যান্ট স্থাপন করার প্রস্তুতি রয়েছে। পাশাপাশি কয়রায় ৪ লাখ পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হয়েছে। একটি ট্যাবলেট দিয়ে ৪-৫ লিটার পানি বিশুদ্ধ করা সম্ভব হবে। স্থানীয় লোকজন যে কোনও উৎস থেকে মিষ্টি পানি সংগ্রহ করে এ ট্যাবলেট দিয়ে তা বিশুদ্ধ করে পান করতে পারবেন। স্থানীয় লোকজনের সুবিধার্থে ২০০টি হাইজিন চিফ বক্স ও ৩০০টি হাইজিন বক্স সরবরাহ করা হয়েছে।

তিনি জানান, কয়রার পাশাপাশি পাইকগাছা ও দাকোপেও একটি করে ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে.

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।