ঘাটতি বাজেট সংসদে বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী

ক্রাইমবার্তা রিপোট:  পৃথিবীতে এত খারাপ সময় কখনও আসেনি। ক্ষুদ্র এক ভাইরাস সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। এই ক্রান্তিকালে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়াই মানুষের সবচেয়ে বড় চাওয়া। করোনাভাইরাস জীবন এবং জীবিকাকে একইসঙ্গে ঝুঁকির মাঝে ফেলেছে। জীবন ও জীবিকার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করে আপাতত টিকে থাকার চেষ্টা করছে সবাই। কঠিন এই বাস্তবতায় আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) জাতীয় বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে করোনাকালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা রয়েছে। যদিও মানুষকে নিরাপদ রেখে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ঘাটতি সেখানে রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, করোনার কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাতের সাময়িক প্রয়োজন মেটানো এবং বিভিন্ন খাতের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলাকে মাথায় রেখে বাজেট তৈরি করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতকে আগের তুলনায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে গরিব মানুষের কষ্ট লাঘবের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে সাময়িক বড় সংকটে পড়া নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষত কাজ হারানো বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।
বাজেটের আয় ও ব্যয়ের প্রাক্কলনে গতানুগতিকতার খুব বেশি বাইরে যেতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। এবার রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নিশ্চিত হয়েও অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন বাস্তবতার বিবেচনায় অনেক বেশি। প্রতিবারই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরা হয়। এদিকে এবার বাজেট ঘাটতি একটু বেশিই ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। ঘাটতি মেটাতে খুব বড় অঙ্কের ঋণের চিন্তা মাথায় রেখে আগামী অর্থবছরে মোট ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছেন ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
করোনা আতঙ্কের মধ্যে এবারের বাজেট নিয়ে মানুষের মধ্যে তেমন আলোচনা ছিল না। যতটুকু আলোচনা ছিল তাতে দেখা গেছে, সবাই চেয়েছেন, স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হোক। সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানো হোক। কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করা হোক। দেশের মধ্যে চাহিদা বাড়ানো হোক। মানুষের হাতে নগদ টাকা আসুক। বাজেটে এসব বিষয়ে কম-বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। সরকারের নেওয়া প্রণোদনা কর্মসূচির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষত করোনার সময়ে যেসব অবকাঠামোগত দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে তার প্রতিকারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঘোষণা করেননি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে। তবে তা এখনকার বাস্তবতায় পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। অবশ্য করোনা মোকাবিলায় জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখায় অর্থমন্ত্রী অনেকের প্রশংসা পাবেন।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে কৃষিতে। তৃতীয় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। চতুর্থ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসৃজন ও পল্লী উন্নয়নে। কভিড- ১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে বিভিন্ন আর্থিক ও প্রণোদনামূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
করোনার কারণে অর্থনীতি আগামী অর্থবছরেও যে স্বাভাবিক হবে না- তা অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। তিনি বলেছেন, জিডিপির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি হবে না। এই আশঙ্কা মাথায় রেখে তিনি রাজস্বনীতি সাজিয়েছেন। অথচ আগামী অর্থবছরের জন্য তিনি জিডিপির ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছেন। এখানে তার নিজের কথার মধ্যেই বৈপরীত্য রয়েছে। বলে রাখা ভালো, বিশ্বব্যাংক মনে করছে, আগামী অর্থবছরে মাত্র ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।

করোনাকালে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব মধ্যবিত্তের জন্য করোনাকালে স্বস্তির খবর। আরেকটি স্বস্তির খবর হলো- চাল, আটাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহে উৎসে কর কমানোর প্রস্তাব। সামাজিক নিরাপত্তার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা রয়েছে। আরও কিছু বিবেচনায় দরিদ্র শ্রেণির প্রতি সুনজর দেওয়া হয়েছে বাজেটে। বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। আগামী অর্থবছরে আরও বেশি সংখ্যক অসহায় প্রবীণ, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা পাবেন। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি চলতি বছরের চেয়ে ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে বর্তমানে অতি সংকটে থাকা ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সরকারের অবস্থান নিয়ে তেমন কিছু নেই। অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন ইস্যুতে আগের পদক্ষেপের বর্ণনা করেছেন বেশি। সে তুলনায় তার বক্তব্যে আগামীর পরিকল্পনার বিষয়ে দিকনির্দেশনা কম।
বাজেটের অঙ্ক :আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের যে প্রবণতা রয়েছে, তাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা এবং আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় তিন লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় দুই লাখ ১৫ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন ছিল। সংশোধিত বাজেটে যা কমিয়ে পাঁচ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা (অনুদান ছাড়া) হয়েছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এবার ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৬ শতাংশ। সাধারণত ৫ শতাংশের বেশি ঘাটতির পরিকল্পনা করা হয় না। এবার বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার একটু বেশি ঋণ করে হলেও অর্থনীতিকে সচল রাখতে চায়। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চায়, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ।
সংসদের পরিস্থিতি :করোনাকালের বাজেট অধিবেশনের শুরু থেকেই সংসদ এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অধিবেশন কক্ষেও ছিল না এবার চিরচেনা সেই উৎসবমুখর পরিবেশ। বৈঠকে অংশ নিতে আসা মন্ত্রী ও এমপিদের সবার মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরা ছিল। কারও কারও মাথায় ছিল আবরণ। বিকেল ৩টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। এরপরই স্পিকার বাজেট পেশ করতে অর্থমন্ত্রীকে আহ্বান জানান। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি নেন এবং কিছু অংশ পঠিত বলে গণ্য করতে স্পিকারকে অনুরোধ জানান। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার কিছু অংশ পড়ার পর ডিজিটাল পদ্ধতিতে অন্যের কণ্ঠে উপস্থাপন করা হয়। শেষের কিছুটা অংশ পড়েন অর্থমন্ত্রী। এর আগে দেশের ৪৯তম বাজেট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এই বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে। মন্ত্রিসভার মাত্র ১১ জন সদস্য অংশ নেন এই বৈঠকে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার শিরেনাম ছিল অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা।
প্রতিক্রিয়া :বাজেটের ওপর প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে আজ। তবে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাজেটে জীবন ও জীবিকার বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তাতে মোটামুটিভাবে তারা করপোরেট কর কমানোর প্রশংসা করেছেন। তবে মোবাইল ফোন ব্যবহারে খরচ বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন কেউ কেউ।

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।