আসাদুজ্জামান সরদার:ঘূণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করতে না পারায় সাতক্ষীরা উপকূলের অনেক এলাকার লোকালয়ে এখনও চলছে জোয়ার-ভাটা। ফলে নদীর সাথে তাল মিলিয়ে রীতিমত জোয়ার ভাটার মধ্যে বসবাস করছে উপকূলীয় দুর্গত জনপদের হাজারও পরিবার। আশ্রয় কেন্দ্রে স্থান সংকুলন না হওয়ায় দূর্গত এলাকার অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে উঁচু বাঁধের উপর মানবেতার জীবন যাপন করছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে এলাকাবাসী ভাঙন পয়েন্টে স্বেচ্ছাশ্রমে বিকল্প রিংবাঁধ নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দ্রুত স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে নদীগর্ভে বিলীন হবে উপকূলের অনেক গ্রাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা এবং অনুলিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মেরামত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও গত ২৩ দিন অতিবাহিত হলেও অনেকে এলাকায় ভাঙন পয়েন্টে এখনও বাঁধ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার কিছু কিছু এলাকায় এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণ করলেও নদীর প্রবল জোয়ারের চাপে তা আবার ভেঙ্গে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা, পদ্মপুকুরের বন্যতলা ও আশাশুনির প্রতাপনগর এবং শ্রীউলা ইউনিয়নের একটি অংশের লোকালয়ে এখনও পর্যন্ত নিয়মিত জোয়ার ভাটা হচ্ছে। এসব এলাকার মধ্যে প্রতাপনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জোয়ার ভাটা হওয়ায় এখানকার প্রায় সব চিংড়ি মাছের ঘের ও ইরিনা ব্রিকস নামের একটি ইটেরভাটা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগস্ত হয়েছে।
আশাশুনির প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, ঘূণিঝড় আম্পানের সাতক্ষীরার মধ্যে বাঁধ ভেঙে সবচেয়ে আমার ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার ৪০ কিলোমিটার বাঁধের সব নষ্ট হয়ে গেছে। আম্পানের প্রভাবে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে চাকলা, দিঘলারআইট, সুভদ্রাকাটি, রুইয়ারবিল, কুড়িকাহুনিয়া, হিজলিয়া কোলাসহ বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে কয়েকটি ভাঙ্গন পয়েন্টে রিংবাঁধ দেওয়া হলেও প্রবল জোয়ারে তোড়ে অধিকাংশ বাঁধ ফের ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পুরো ইউনিয়নে এখনও নদীতে জোয়ার হলে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে, অবার ভাটায় পানি নেমে যায়। নিয়মিত জোয়ার ভাটায় ইউনিয়নের সব মাছের ঘেরসহ অন্যান্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশ ও বস্তা দেওয়া ছাড়া কোন সহযোগিতা করেনি। চাকলা, কুড়িকাহুনিয়া, হরিষখালি পয়েন্টের ভাঙ্গন দিয়ে লোকালয়ে এখনো পানি প্রবেশ করছে। দ্রুত স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে প্রতাপনগর ইউনিয়নসহ উপকূলের অনেক এলাকা।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর জরাজর্ণি বেড়িবাঁধ ভেঙে আশাশুনি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হলেও কাজ হয়না। পানিতে হাবু-ডুবু খেতে খেতে নাকাল হয়ে পড়ে এ জনপদের মানুষ। ঝড়ে ক্ষয়-ক্ষতি না হলেও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জীবন ও সম্পদ হারায় তারা। অনেক মানুষ এখনো বাঁধের উপর ছাপড়া বেধে মানবেতার জীবন যাপন করছে।
শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা সাকিল জানান, অম্পানের প্রভাবে খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে প্রতাপনগরের কোলা ও শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালী পয়েন্টে পাউবো’র ভেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ওই দু’টি পয়েন্ট দিয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে জোয়ারের পানি ঢুকে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে নিয়মিত জোয়রা-ভাটা হচ্ছে। বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে কোলা পয়েন্টে পানি ঢোকা আপাতত: বন্ধ করা সম্ভব হলেও হাজরাখালী পয়েন্ট দিয়ে নদীর পানি ঢোকা ও বের হওয়া অব্যহত রয়েছে।
শ্যামনগরের কাশিমাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ বলেন, আম্পানে খোলপেটুয়া নদীর ৬টি পয়েন্টে ২কিলোমিটার বাঁধ ভেঙ্গে পুরো ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। কিন্তু ছোট ছোট দুটি স্থান ছাড়া ভেঙে যাওয়া অধিকাংশ স্থানের বাঁধ মেরামত করা যায়নি। পরে স্থানীয় মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও জোয়ারের পানিতে চিংড়িখালি খালের চার ফিট বাঁধ ভেঙ্গে পুরা ইউনিয়ন আবাও প্লাবিত হয়েছে। এখনও এলাকায় জেয়ার-ভাটা হচ্ছে। কাশিমাড়ি ইউনিয়নের ঝাঁপালির চিংড়িখাল ও খোলপেটুয়া নদীর বাঁধর ভেঙে ১০টি গ্রাম এবং কালিগঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের তিন গ্রামের মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। ফলে নদীর সাথে তাল মিলিয়ে রীতিমত জোয়ার ভাটার মধ্যে বসবাস করছে উপকূলীয় দুর্গত জনপদের হাজারও পরিবার।
শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, আম্পানের পর লেবুবুনিয়া, নাপিতখালি ও জেলেখালি এলাকায়র বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। এই ইউনিয়নের মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২০ কিলোমিটার ভেঙে যায়। এলাকারবাসীকে সাথে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রিং বাঁধা হয়েছে। তারপরও সেগুলো টিকছে না। মাঝে মধ্যে অবার ভেঙ্গে জোয়ারের পানি উঠে এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে জোয়ার ভাটায় পানি ওঠানামা করছে। সামনের বড় গোনের আগে মূল বাঁধের কাজ না করতে পারলে আবাও পুরো এলাকা প্লাবিত হবে। সেনা প্রধান বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন কররেছেন খুব দ্রুত লেববুনিয়ায় সেনাবাহিনী মুল বাধের কাজ শুরু করবে।
শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আতাউর রহমান জানান, আম্পানে তার ইউনিয়নের বন্যতলা, কামালকাটি, ঝাপা, ছোট চন্ডীপুর, পূর্ব পাতাখালি, পশ্চিম পাতাখালি, খুঁটিকাটা ও চাউলখোলা পয়েন্টগুলোর বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। মোট ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২৪ কিলোমিটার ভেঙ্গে যায়। এসব এলাকার বাঁধগুলো স্বেচ্ছাশ্রমের বিত্তিতে রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বন্যা তলার বাঁধ ভেঙে কিছু এলাকা আবার প্লাবিত হয়েছে। তাই সবার আগে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ সংস্কার জরুরী। আমরা শুধু মাত্র পাটি ঠেকানোর জন্য রিংবাঁধ দিয়েছে। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেই যে কোন মুহুর্তে আবারও তা ভেঙে প্লাবিত হবে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনম আবুজার গিফারী বলেন, আম্পানের ক্ষতিগ্রস্ত শ্যামনগরের বাঁধগুলো এলাকাবাসীর সেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এখন শুধুমাত্র পদ্মপুকুর ইউনিয়নের একটি পয়েন্টে ও কাশিমাড়ি ইউনিয়নের দুটি পয়েন্টে কাশিমাড়ি ও ঘোলা রিং বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। তবে সব জায়গায় কাজ কাজ চলছে। গাবুরার লেববুনিয়া বাঁধ ছাপিয়ে মাঝে মধ্যে পানি চলে আসে। এই পয়েন্টে খুব দ্রুত সেনাবাহিনী কাজ শুরু করবে। এছাড়া যারা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করেছে তাদের সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মীর আলিফ রেজা বলেন, আম্পানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নে। প্রতাপনগরের পুরো ইউনিয়নের মানুষ এখনও পানিবন্দী। ওই ইউনিয়নের সব মৎস্য খামার ও ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রতাপনগরের চাকলা, শুভদ্রাকাটি, কুড়িকাহুনিয়া, কোলা, হরিষখালি, হিজলাসহ ৬টি পয়েন্টে ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। পরে স্থানীয়দের সহয়তা রিং বাঁধ দেওয়া হলেও সেগুলো আবারও ভেঙে এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। তাদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরোও বলেন, শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজরাখালিতে অনেক গভীর হওয়ার কারণে রিংবাঁধ সম্ভব হচ্ছে না। হাজরাখালি বাঁধ ভাঙার কারণে হাজরাখালী, মাড়িয়ালা, লাঙ্গল, দাড়িয়া, কলিমাখালিসহ ১০টি গ্রামে এখনও জোয়ার ভাটা হচ্ছে। আশাশুনি সদর ইউনিয়নের জেলেখালি, দয়ারঘাট, বলাবাড়িয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়। অধিকাংশ স্থানে রিংবাঁধের কাজ চলছে। মূল বাঁধের কাজ শুরু করা এখনো সম্ভব হয়নি। আশাশুনি সদরের দয়ারঘাট ও বলাবাড়িযা কাজ চলছে। পানি উন্নন বোর্ডের কাজ এখনও শুরু করেনি। তারা বস্তা ও বাঁশ দিচ্ছে। যে সব মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছে তাদের জন্য টিআর বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।