সাতক্ষীরায় ১১ লক্ষ মানুষ নিরাপদ পানি ঝুকিতে

আবু সাইদ বিশ্বাস,  উপকূলীয় অঞ্চল ঘুরে: ক্রাইমর্বাতা রিপোট: সাতক্ষীরা: ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সূপেয় পানির উৎস নষ্ট হওয়ায় তীব্র পানি সংকটে পড়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার কয়েক লক্ষ মানুষ। চারপাশে সুবিশাল জলরাশি সত্ত্বেও পানের উপযোগী পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সমুদ্রের লোনা পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় নতুন করে মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পানিবাহিত নানা রোগসহ আর্সনিকের কবলে পড়তে হচ্ছে জেলার সিংহ ভাগ মানুষের। সূত্র মতে জেলার ৪০ ভাগ মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এতে জেলার প্রায় ১১ লক্ষ মানুষ নিরাপদ পানি ঝুকিতে রয়েছে।

জেলায় শতকরা কতভাগ মানুষ সুপেয় পানি পান করছেন তার কোনো সঠিক তথ্য নেই জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদফতরে। মৌখিক ভাবে ৬০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে বলে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদফত এর দাবী। তবে বেসরকারী সূত্রমতে জেলাতে ৬০ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি বঞ্চিত। ১৯৯০ সালের পর থেকেই জেলার তালা, আশাশুনি ও শ্যামনগরে খাবার পানির সংকট শুরু হয়। এর জন্য অপরিকল্পিতভাবে লোনা পানির চিংড়ি চাষ, প্রাকৃতিক দুযোর্গ, নদী ভাঙ্গনকে দায়ী করছে উপকুলীয়বাসী।

ইউনিসেফের তথ্য মতে ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের অর্ধেক দেশই পড়বে, সুপেয় পানি সংকটে। ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রতি ৪ জন শিশুর মধ্যে একজন মারা যাবে, বিশুদ্ধ পানির অভাবে-এমন সতর্কতা ইউনিসেফের। আর ২০৫০ এ সুপেয় পানির জন্য হাহাকার উঠবে, বিশ্বের ৭৫ ভাগ মানুষের। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭ টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বরটি সুপেয় পানি অন্যতম।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাকৃতিক উৎসগুলো শুকিয়ে যাওয়া, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়া, সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা জলাধারগুলো চাহিদা পূরণে সক্ষম না হওয়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান খাওয়ার উপযোগী পানির এ সমস্যা তাঁদের দৈনন্দিন ও প্রাত্যিহিক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৗশল অধিদপ্ত সাতক্ষীরা সূত্রে জানা যায়, গতএক বছরে জেলাতে ৫হাজার ৪১০টি মিঠা পানির উৎস নষ্ট হয়েছে। সূত্রমতে জেলাতে মোট ৩৭ হাজার ৪৬৫টি হস্তচালিত নলকূপ রয়েছে। যার মধ্যে অকেজো রয়েছে ৫ হাজার ৪১০টি এবং সচল রয়েছে ৩২ হাজার ৫৫টি। তবে বাস্তবতা হলো অকেজোর সংখ্যা আরো বেশি।

এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে চালু রয়েছে ৬১০৩টি এবং অকেজো রয়েছে ৫০৪টি। কলারোয়াতে চালু রয়েছে ৫৩২৯টি এবং অকেজো রয়েছে ৪৪০টি। তালাতে চালু রয়েছে ৫২৬৯টি এবং অকেজো রয়েছে ২৭৪টি। আশাশুনিতে চালু রয়েছে ৩৫১৯টি এবং অকেজো রয়েছে ১৭২১টি। দেবহাটাতে চালু রয়েছে ৩১৩৫টি এবং অকেজো রয়েছে ১১২টি। কালিগঞ্জে চালু রয়েছে ৩৭২৭টি এবং অকেজো রয়েছে ১৯৭১টি। শ্যামনগরে চালু রয়েছে ৪৫২৫টি এবং অকেজো রয়েছে ৩৮৮টি। সাতক্ষীরা পৌরসভাতে চালুরয়েছে ৪৪৮টি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আম্ফানের কারণে ধসে গেছে শ্যামনগর উপকূলের বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি আশাশুনি, সদর প্রতাপনগর, শ্রীউলার অধিকাংশ বেড়িবাঁধ। এতে এলাকায় বানের পানি ঢুকে পড়েছে। প্রতাপনগর ও কামিমাড়ী ইউনিয়ন্ এখনও এখনো পানির তলে।

সুন্দরবন সংলগ্ন চুনুর নদীর বেড়িবাঁধ সংলগ্নে অনেকের বসবাস। বাপ দাদার পূর্বপুরুষ থেকে বসবাস করে আসছে বুড়িগোয়ালিনী সংলগ্ন জেলে পল্লিতে। কথা হয় হানিফ গাজীর সাথে। তিনি জানান,তারা খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে তারা পুকুরের পানি ব্যবহার করেন। ছোট দুটো পুকুর থেকে এলাকার কয়েকশ মানুষ পানি নিয়ে যান। বর্তমানে সেই পানি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তার দাবী কয়েকটি টিউভওয়েল স্থাপন করলে সেখানে মিঠা পানি পাওয়া যাবে।
একই দাবী একই এালাকার জাফর আলী মোল্লা,কামরুজ্জামান,ইউসূপ গাজীসহ অনেকেরই।

তারা জানান,বৃহৎ উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীকে খাবার পানির সংস্থানে একেক ঋতুতে একেক ধরনের উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়। বৃষ্টির সময় বাড়িতে বাড়িতে রিজার্ভ ট্যাংকে সংগৃহীত পানি (যা দিয়ে তিন চার মাস চলে), বাকি সময়ে কখনো পুকুর ফিল্টার (যদিও লবণাক্ততার কারণে এ উৎসটি হুমকির মুখে) বা সরাসরি পুকুরের পানি অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্টই (আর ও প্ল্যান্ট) হচ্ছে এখানকার মানুষের খাবার পানির উৎস। গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশির ভাগ অচল থাকে।

পানি বিশেজ্ঞারা মনে করেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে অবস্থানের কারণে সাতক্ষীরার তালা, শ্যামনগর এবং আশাশুনি উপজেলায় পানিসংকট অন্য উপজেলার থেকে বেশি। সুতরাং এসব এলাকায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি পানি সংকটকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে গেলে করোনা মোকাবিলার অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ যেমন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রশাসনের জন্য কষ্টকর হয়ে যাবে বা হচ্ছে।

কাশিমাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এসএম আব্দুর রউফ জানান, তার ইউনিয়নে ১৮টি গ্রাম এখনো পানির মধ্যে।“বেড়িবাঁধ ভেঙে পুকুরগুলেতে লবণাক্ত পানি ঢুকে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। ময়লা ও নোনা পানি ব্যবহারে গায়ে চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে। গভীর নলকূপগুলো নদীর পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অন্য কোনো জায়গা থেকেও পানি আনা যাচ্ছে না।”

স্বেচ্ছাসেবী কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে বাঁধ ভেঙে এলাকা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ড্রাম থেকে পানি বিতরণ করতে দেয়া যায়। যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।

সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশেদ আলী জানান,জেলাতে সুপেয় পানির সংকট দূর করতে কার্যকরী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ ভৌগলিক নানা কারণে নতুন নতুন পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে। তবে উপকূলীয় জেলা হওয়াতে দিন দিন লবণক্ষতা আর্সেনিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকট সমাধান কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়ছে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আনম আবুজর গিফারী বলেন, ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের পর থেকে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে র্সূপেয় পানি,পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট,জারসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। এর পর সূপেয় পানির উৎস তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছ্।ি তবে মাটিতে লবাণক্ষতার পরিমাণ বৃদ্ধিও কারণে মিষ্টি পানির উৎস ধরে রাখা কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে।

 

Check Also

যশোর বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় কলারোয়ার আ’লীগ কাউন্সিলর গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিনিধি :- সাতক্ষীরা: যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।