প্রফেসর ইউনূসের মতে:
করোনা মহামারি পৃথিবীর যে ক্ষতিসাধন করছে এক কথায় তা কল্পনাতীত। এই বিশাল ক্ষতি সত্ত্বেও এই মহামারি মানব জাতির সামনে একটি এমন সুযোগ এনে দিয়েছে তা আরো বেশি কল্পনাতীত।
এই মুহূর্তে মানুষের মাথায় একটি বড় প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনার এই ধ্বংস যজ্ঞ থেকে বের হয়ে কীভাবে আবার বিশ্ব অর্থনীতিকে পুণর্গঠন করবো। সৌভাগ্যক্রমে এর উত্তর আমাদের জানা। একটি পুনরুদ্ধার কর্মসূচি কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হয় সে অভিজ্ঞতা আমাদের ভালোই আছে। যে প্রশ্নটা আমি তুলে ধরতে চাচ্ছি সেটা কিন্তু ভিন্ন। সবার কাছে আমার প্রশ্ন হলো: করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে পৃথিবীটা যেখানে ছিল আমরা কী তাকে সে-জায়গাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবো? নাকি আমরা একে নতুন ভাবে গড়ে তুলবো? সিদ্ধান্তটা পুরোপুরিই আমাদের হাতে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, করোনা-পূর্ববর্তী পৃথিবীটা আমাদের জন্য মোটেই ভালো ছিল না। পৃথিবী প্রায়ই ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গিয়েছিল।
করোনাভাইরাসের মহাদুর্যোগ না আসা পর্যন্ত পৃথিবীতে কী কী ভয়ানক জিনিষ ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে পৃথিবী মানবজাতির টিকে থাকার জন্য একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে যাবার শেষ সীমায় এসে পৌঁছে গিয়েছিল। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স সৃষ্ট ব্যাপক বেকারত্ব সমাজকে ভয়ংকর হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে সমস্ত সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে মাত্র গোটা কয়েক মানুষের হাতে চলে গিয়েছিল – যার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর শেষ ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা একে অপরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলাম যে, বর্তমান দশকটাই আমাদের জন্য শেষ সুযোগের দশক; এরপর আমাদের সকল প্রচেষ্টারই ফলাফল হবে অতি নগণ্য। তা দিয়ে পৃথিবীকে আর রক্ষা করা যাবে না।
আমরা যে পৃথিবীর বর্ণনা করলাম সেই পৃথিবীতেই ফিরে যেতে চাই? আমাদের কী আর কোনো উপায় নেই?
অবশ্যই আছে। আমরা সে-পৃথিবীতে ফিরে যেতে বাধ্য নই। যাবো কি যাবো না, সেটা আমাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এটা চিন্তা করার সুযোগ পাওয়াটাই একটা মহামুক্তি।
করোনাভাইরাস অকস্মাৎ প্রেক্ষাপটটা বদলে দিলো এবং পৃথিবীর ক্যালকুলাস পাল্টে দিলো। এর ফলে এমন এক প্রবল সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল যা আগে কখনো দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই আমরা ইচ্ছামতভাবে পুনর্জন্ম লাভের সুযোগ পেয়ে গেলাম। এখন আমরা যে-কোনো দিকেই অগ্রসর হতে পারি। পথ বেছে নেয়ার কি অকল্পনীয় সুযোগ এটা।
অর্থনীতিকে আবারো সচল করার আগে আমাদেরকে একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, আর তা হচ্ছে – কোন ধরনের অর্থনীতি আমরা চাই। তবে সবার আগে আমাদের এ বিষয়ে একমত হতে হবে যে, অর্থনীতিটা হচ্ছে একটা ‘উপায়’, একটা কর্মপদ্ধতি। আমরা যে লক্ষ্যগুলো স্থির করি অর্থনীতি সেগুলো অর্জনে সাহায্য করে মাত্র। এটা এমন কোনো মৃত্যুফাঁদ নয় যেটা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি আমাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য তৈরী করেছেন। আমাদের এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না যে, এটা আমাদেরই তৈরী একটি যন্ত্র মাত্র। আমাদেরকে প্রতিনিয়তই এর নকশা তৈরী করতে ও এই নকশা পুনঃসৃষ্টি করে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তা আমাদের জন্য সর্বোচ্চ সমষ্টিগত সুখ নিশ্চিত করে।
কখনো যদি আমাদের এমনটা মনে হয় যে এটা আমাদেরকে কাম্য পথে নিয়ে যাচ্ছে না, আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি যে আমাদের ব্যবহার করা হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যারে কোথাও কোনো সমস্যা আছে। আমাদের তখন যা করতে হয় তা হলো সমস্যাটা মেরামত করা। আমরা একথা বলে পার পেতে পারি না যে, ‘দুঃখিত, আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারছি না কেননা আমাদের সফটওয়্যার বা হার্ডওয়্যার এটা করতে দেবে না।‘ সেটা হবে একেবারেই খোঁড়া, অগ্রহণযোগ্য একটা যুক্তি। আমরা যদি শূন্য নীট কার্বন নিঃস্বরণের একটা পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাই তাহলে আমাদেরকে এজন্য সঠিক হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরী করতে হবে। আমরা যদি শূন্য বেকারত্বের একটা পৃথিবী গড়তে চাই তাহলেও তা-ই করতে হবে। আমরা যদি এমন একটা পৃথিবী চাই যেখানে সম্পদের কোনো কেন্দ্রীকরণ থাকবে না, তাহলেও সেটাই আমাদেরকে করতে হবে। অর্থাৎ এই সবকিছুর জন্যই দরকার সঠিক হার্ডওয়্যার ও সঠিক সফটওয়্যার। আর এজন্য প্রয়োজনীয় সব ক্ষমতাই আমাদের হাতে। মানুষ যখনই কোনো কিছু করতে মনস্থির করে, তারা তা করে ছাড়ে; পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কিছু নেই।
তবে সবচাইতে বড় সুসংবাদটি হচ্ছে, করোনা সংকট আমাদেরকে একেবারে নতুন করে সবকিছু শুরু করার প্রায় সীমাহীন একটা সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। আমরা আমাদের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারগুলো প্রায় নতুন করে তৈরী করার কাজ শুরু করতে পারি।
করোনা-উত্তর পুনর্গঠনকে হতে হবে সামাজিক সচেতনতা চালিত পুনর্গঠন
শুধু একটি বিষয়ে বৈশ্বিক ঐকমত্য আমাদেরকে অনেকদুর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে: একটি সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত যে, আমরা যেখান থেকে এসেছি সেখানে আর ফিরে যেতে চাই না। পুনরুদ্ধারের নামে আগের সেই জ্বলন্ত কড়াইতে ঝাপ দিতে চাই না।
একে ‘পুনরুদ্ধার’ কর্মসূচি বলাটাই আসলে ঠিক হবে না
আমাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করার প্রয়োজনে আমরা একে ‘পুনর্গঠন’ কর্মসূচি নামে অভিহিত করতে পারি। আর এটা সম্ভব করে তুলতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করার উদ্দেশ্যে তৈরী করা হবে বিভিন্ন ব্যবসা। করোনা-পরবর্তী পুনঃনির্মাণ কর্মসূচির জন্য প্রারম্ভিক সিদ্ধান্ত হতে হবে সমাজ ও পরিবেশগত সচেতনতাকে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রস্থলে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা। সরকারগুলোকে অবশ্যই এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, ব্যয়কৃত প্রতিটি টাকা অন্য সকল বিকল্পের তুলনায় সমাজকে সর্বোচ্চ সামাজিক ও পরিবেশগত সুফল দেবে এটা নিশ্চিত না হয়ে কাউকে একটি টাকাও দেয়া হবে না। পুনর্গঠনের সকল কর্মোদ্যোগকে দেশের এবং সার্বিকভাবে পৃথিবীর জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে সচেতন একটি অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিয়োজিত হতে হবে।
এখনই সময়
আমরা শুরু করবো সামাজিক সচেতনতা চালিত ‘পুনর্গঠন’ প্যাকেজগুলো নিয়ে। আমাদেরকে এখনই – যখন আমরা সংকটের গভীরতম পর্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি – আমাদের পরিকল্পনাগুলো তৈরী করে নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে – এই সংকট যখন সমাপ্তি পর্বের দিকে আসতে থাকবে তখন পুরনো সব পদ্ধতিগুলোর সুফলভোগীরা আবারো সুফলগুলো লুফে নেবার প্রতিযোগিতায় হুড়মুড় করে এগিয়ে আসবে। নতুন উদ্যোগগুলোকে পথচ্যুত করতে শক্তিশালী যুক্তি দেখানো হবে যে এই কর্মপন্থাগুলো ‘পরীক্ষিত’ নয়। (আমরা যখন প্রস্তাব করেছিলাম যে, অলিম্পিক গেম্সকে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ডিজাইন করা সম্ভব তখন বিরোধীরা একই যুক্তি দেখিয়েছিল। এখন প্যারিস অলিম্পিককে প্রতিটি পদক্ষেপে অধিকতর উৎসাহের সাথে সামাজিক ব্যবসা হিসেবেই ডিজাইন করা হচ্ছে।) আমাদেরকে হুড়োহুড়ি শুরু হবার আগেই তৈরী হয়ে যেতে হবে। আর তা এখনই।
সামাজিক ব্যবসা
এই ব্যাপক পুনর্গঠন পরিকল্পনায় আমি একটি নতুন ধরনের ব্যবসাকে – যাকে আমি সামাজিক ব্যবসা বলি, কেন্দ্রীয় ভুমিকা দেবার প্রস্তাব করছি। এই ব্যবসাটি সৃষ্টিই করা হয়েছে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার জন্য। এই ব্যবসা থেকে বিনিয়োগকারী শুধু তাঁর মূল বিনিয়োজিত অর্থটুকুই ফেরত পান, কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা বা লভ্যাংশ পান না। বিনিয়োগকারীর মূল বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দেবার পর অর্জিত মুনাফা এই ব্যবসাতেই বিনিয়োজিত হয়।
বড় ধরনের পুনর্গঠনের দায়িত্ব নেবার জন্য সরকারগুলোর কাছে সামাজিক ব্যবসাগুলোকে উৎসাহিত করতে, অগ্রাধিকার দিতে এবং এদেরকে স্থান করে দিতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ থাকবে। একই সময়ে সরকারগুলোর এমনটি প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না যে, সামাজিক ব্যবসাগুলো চাহিদামতো সময় ও মাপে সকল জায়গায় তৈরী হয়ে যাবে। সরকারগুলোকে অবশ্যই তাদের কর্মসূচিগুলো চালু করতে হবে, যেমন প্রচলিত কল্যাণ কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে হতদরিদ্র ও বেকারদের দেখাশোনা করা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, অত্যাবশ্যকীয় সেবাগুলো পুনরায় চালু করা, এবং সেসব ব্যবসাগুলোকে সহায়তা দেয়া যেখানে সামাজিক ব্যবসার প্রসার ধীর গতিতে হয়।
সামাজিক ব্যবসার প্রসারকে ত্বরান্বিত করতে সরকারগুলো কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটেল ফান্ড গঠন করতে পারে, বেসরকারী খাত, বিভিন্ন ফাউন্ডেশন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ তহবিলগুলোকে সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটেল ফান্ড তৈরী করতে উৎসাহিত করতে পারে, প্রচলিত ব্যবসাগুলোকে নিজেদেরকে সামাজিক ব্যবসায়ে পরিণত হতে বা কোনো সামাজিক ব্যবসাকে অংশীদার করে নিতে উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়াও কর্পোরেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজ নিজ সামাজিক ব্যবসা তৈরী করতে বা সামাজিক ব্যবসা পার্টনারদের সাথে যৌথ উদ্যোগে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করতে পারে।
পুনর্গঠন কর্মসূচির অধীনে সরকারগুলো বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসাকে অর্থায়ন করতে পারে যাতে তারা অন্য কোম্পানী ক্রয় করতে পারে বা কোনো অভাবগ্রস্ত কোম্পানীতে অর্থ লগ্নী করে তাকে সামাজিক ব্যবসায়ে রুপান্তরিত করতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামাজিক ব্যবসাগুলোকে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তহবিল নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার অনুমোদন দিতে পারে।
পুনর্গঠন প্রক্রিয়া একবার শুরু হয়ে গেলে তখন আরো অনেক সুযোগ তৈরী হবে; সরকারের উচিত হবে যত বেশি সম্ভব সামাজিক ব্যবসাকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা।
সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী কারা?
সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী কারা? এদেরকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে?
এরা সব জায়গাতেই আছে। আমরা এদেরকে দেখতে পাই না কেননা অর্থশাস্ত্রের প্রচলিত পাঠ্য বইগুলোতে এদের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয়না। এর ফলে আমাদের চোখও এদেরকে দেখতে অভ্যস্ত নয়। তবে বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণের প্রশংসার কারণে অর্থনীতির কোর্সগুলোতে সম্প্রতি সামাজিক ব্যবসা, সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগ, অভিঘাত বিনিয়োগ, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এগুলো সম্পর্কিত আলোচনা মূল তত্ত্বগুলোর পাশাপাশি অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে।
অর্থশাস্ত্র যতদিন মুনাফা সর্বোচ্চকরণের একটি বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হবে ততদিন আমরা সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা-ভিত্তিক একটি পুনর্গঠন কর্মসূচি হিসেবে এর উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারবো না। আমাদের পুরো কর্মকৌশলটাকে হতে হবে অর্থনীতির সম্প্রসারণের সাথে সাথে এর মধ্যে সামাজিক ব্যবসার অনুপাতটাকে বড় করে আনা। সামাজিক ব্যবসার সফলতা তখনই দৃশ্যমান হবে যখন সমগ্র অর্থনীতিতে এর অনুপাতটাই যে শুধু বড় হয়ে আসবে তাই নয়, উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দুই ধরনের ব্যবসাতেই বিনিয়োগ করছে এমন উদ্যোক্তার সংখ্যাও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পাবে। আর এটাই সংকেত দেবে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতা-ভিত্তিক অর্থনীতির প্রকৃত যাত্রারম্ভের।
সরকারী নীতি সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদেরকে স্বীকৃতি দেয়া শুরু করলেই এই উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা এই ঐতিহাসিক সুযোগে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালনে প্রবল আগ্রহে এগিয়ে আসবে। সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তারা সমাজে ‘ভাল কাজ করা’ মানুষদের একটা ছোট দল নয়। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইকো-সিস্টেম যার অন্তর্ভূক্ত বিশালায়তন বহুজাতিক কোম্পানীগুলো, বৃহৎ সামাজিক ব্যবসা তহবিলসমূহ, বহু প্রতিভাবান প্রধান নির্বাহী, কর্পোরেট সংস্থাগুলো, ফাউন্ডেশনসমূহ ও ট্রাস্টসমূহ যাদের বৈশ্বিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক ব্যবসা অর্থায়ন ও পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সামাজিক ব্যবসার তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা একবার সরকারী মনোযোগ আকর্ষণ করলে অনেক কট্টর ব্যক্তিগত মুনাফাসন্ধানীও তাদের অনাবিস্কৃত প্রতিভার একটি অংশ সফল সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তা হবার কাজে ব্যবহার করতে পারলে এবং জলবায়ু সংকট, বেকারত্ব সমস্যা, সম্পদ কেন্দ্রীকরণ সমস্যা ইত্যাদির সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভুমিকা রাখার সুযোগ পেলে আনন্দ বোধ করবে।
মানুষ উদ্যোক্তা হয়েই জন্মায়, অন্যের চাকরি করতে নয়
পুনর্গঠন কর্মসূচিকে অবশ্যই নাগরিকদের ও সরকারের ভেতরকার একটি প্রথাগত শ্রম বিভাজনকে ভাঙতে হবে। এটা ধরে নেয়া হয়েছে যে, নাগরিকদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের পরিবারের দেখাশোনা করা ও কর প্রদান করা। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে (এবং সীমিত আকারে অলাভজনক খাতেরও) সকল যৌথ সমস্যার দেখভাল করা, যেমন জলবায়ু, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, জল সরবরাহ ইত্যাদি। পুনর্গঠন কর্মসূচিকে এই বিভাজনের দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং নাগরিকরা সকলে যাতে নিজে থেকে এগিয়ে এসে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এসকল সমস্যা সমাধানে তাদের প্রতিভা প্রদর্শন করতে পারে সেজন্য তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের প্রকৃত শক্তি হবে তাদের এই উদ্যোগগুলোর আকার নয়, বরং এগুলোর সংখ্যা। ছোট ছোট এসব উদ্যোগের সংখ্যা বিশাল হলে এগুলোর সম্মিলিত শক্তি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মযজ্ঞে পরিণত হবে। যে সমস্যাটির সমাধানে সামাজিক ব্যবসা উদ্যোক্তারা এখনই এগিয়ে আসতে পারে তা হলো অর্থনীতির ভেঙ্গে পড়া থেকে সৃষ্ট ব্যাপক বেকারত্ব। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ধরনের সামজিক ব্যবসা সৃষ্টি করে বেকারদের জন্য কাজ তৈরীতে লেগে পড়তে পারে। এর পাশাপাশি তারা বেকাররা যাতে উদ্যোক্তায় পরিণত হতে পারে সে বিকল্পও তাদের সামনে খোলা রাখতে পারে যা প্রমাণ করবে যে মানুষ মূলত উদ্যোক্তা হয়েই জন্মায়, চাকরি খোঁজার জন্য নয়। এছাড়া সামাজিক ব্যবসাগুলো সরকারী ব্যবস্থার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তৈরীর কাজেও নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারে।
সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীকে যে অপরিহার্যভাবে কোনো ব্যক্তিই হতে হবে তা নয়, সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারী হতে পারে কোন বিনিয়োগ তহবিল, ফাউন্ডেশন, ট্রাস্ট বা কোন সামাজিক ব্যবসা ব্যবস্থাপনা কোম্পানী। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই বিভিন্ন কোম্পানীর প্রথাগত মালিকদের সাথে কীভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে কাজ করতে হয় তা খুব ভালো জানে। করোনা-পরবর্তী জরুরি পরিস্থিতিতে সরকারের দিক থেকে একটি সঠিক আহ্বান একটি বিপুল, অভূতপূর্ব কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারে। এটা পৃথিবীর সামনে তরুণ, মধ্যবয়সী, বয়স্ক নারী-পুরুষদের মধ্য থেকে একেবারে অজানা বিভিন্ন উপায়ে পৃথিবীকে নবজন্মে অনুপ্রাণিত করার নেতৃত্বের একটা চমৎকার পরীক্ষা।
আমাদের লুকানোর কোনো জায়গা নেই
আমরা যদি করোনা-উত্তর একটি সামাজিক ও পরিবশেগত সচেতনতা চালিত পুনর্গঠন কর্মসূচি নিতে ব্যর্থ হই তাহলে করোনার চেয়েও বহুগুণ ভয়াবহ দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা নিজের ঘরে লুকিয়ে থেকে করোনাভাইরাস থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু আমরা যদি ক্রমাবনতিশীল বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে ব্যর্থ হই তাহলে ক্রুদ্ধ প্রকৃতি ও গণমানুষের রোষ থেকে লুকানোর কোনো জায়গা আমাদের থাকবে না।
মূল ইংরেজী থেকে অনূদিত
অনুবাদক: কাজী নজরুল হক