চীন- ভারত সংঘাত : বাংলাদেশ কী করবে ?

*মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ: চীন- ভারত বিশ্বের দুই জনবহুল দেশ। ১৯৫০ সালে তারা কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপণ করলেও ১৯৬২ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৩৫০০ কিমি ব্যাপী তাদের সীমান্ত রয়েছে। চীনের দাবী ভারতের শাসনাধীন অরুণাচল প্রদেশ তাদের (প্রায় ৯০ হাজার বর্গ কিমি)। ভারতের দাবী বৌদ্ধ অধ্যুষিত লাদাখের (প্রায় ৩৮ হাজার বর্গ কিমি) আকসাই চীন এলাকা চীনারা দখল করে রেখেছে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর উভয় দেশের সেনারা যে সীমানায় অবস্থান নিয়ে চলে তাকে আন্তর্জাতিক ভাবে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা’ লাইন অব এ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল ( এলএসি) বলা হয়ে থাকে। চীন ও ভারত সেনারা অনির্ধারিত ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা’ বরাবর প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে থাকে।
১৯৫০ এর দশকে চীন-ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সম অংশীদার ছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালে চীন তিব্বতে অভিযান পরিচালনা করলে ভারত সেখানকার ধর্মগুরু দালাইলামাকে আশ্রয় দেয়। দালাইলামা ভারতের ধর্মশালায় একটি প্রবাসী সরকার পরিচালনা করে থাকেন বলে চীনের অভিযোগ। ১৯৬২ সালের পর ১৯৬৭ তে উভয় দেশ নাথুলা ও চোলা ভ্যালি এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। ১৯৭৫ সালে সীমান্তে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য মারা যায়। ১৯৮৭ সালে অরুণাচল প্রদেশকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য করলে চীন তার প্রতিবাদ করে। আলোচনার মাধ্যমে সে সময়কার উত্তেজনা প্রশমিত হয়। ১৯৯৬ সালের এক চুক্তিতে উভয় দেশ সীমান্ত সংঘর্ষে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে একমত হয়। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না হলে ও সংঘর্ষ থেমে নেই।
২০১৭ সালে ভুটানের ডেকোলাম এলাকায় চীনারা অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করায় ভারত তাতে বাঁধা প্রদান করলে উত্তেজনা চরমে ওঠে। এ সংকট ৭৩ দিন স্থায়ী হয়। সে বারের মতো চীন রাস্তা-ঘাট তৈরি বন্ধ রাখলেও সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। চলতি বছর এপ্রিলের শেষে ভারতের একজন সিনিয়র কমান্ডার বহনকারী হেলিকপ্টারকে চীনারা দুইটি হেলিকপ্টার দিয়ে বাঁধা প্রদান করে।
অন্য দিকে চীনাদের ক্ষোভ হলো, সীমান্তে অব্যাহত ভারতীয় অবকাঠামো নির্মাণ। ভারত সীমান্তে রাস্তা , ব্রিজ সহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ- বিশেষ করে দৌলত বেগ ওল্ডিতে সামরিক বিমান উড্ডয়ন সুবিধা সম্বলিত সড়ক নির্মাণ করেছে। যা বিশ্বের উচ্চতম বিমান অবতরণ-উড্ডয়ন ক্ষেত্র বটে। এছাড়া বিভিন ছোট ছোট ফিডার সড়ক নির্মাণ চীনা আক্রমনকে তরান্বিত করেছে।
গত ৫ মে, লাদাখের পাঙগো তসো হ্রদ এলাকায় ভারতীয়রা অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করলে উভয় দেশের সেনারা হাতাহাতি ও পাথর ছোড়াছুড়ির মাধ্যমে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এতে দুই পক্ষের ১১ জন সৈন্য আহত হয়।এর তিনদিন পর এর ১২০০ কিমি পূর্বে সিকিম সন্নিহিত নাথুলা গিরিপথে চীনারা একটি ভারতীয় টহল দলকে থামানোর পর উভয় পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ভারতীয় সূত্র মতে, চীনারা পাঙগো তসো লেক, গালওয়ান ভ্যালি, লাদাখের ডেমচোক, সিকিম সন্নিহিত নাথুলা তাদের বলে দাবী করছে। গত ১৫ জুন উভয় দেশের সেনা কর্মকর্তারা উত্তেজনা প্রশমনে ১১ ঘন্টার দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন।
এ সমঝোতা বৈঠকের পর ঐদিন (১৫ জুন) রাতে ভারতীয় সেনারা একজন কর্নেল পদমর্যাদার অফিসারের নেতৃত্বে চীনা সেনা চৌকি এলাকায় টহলে যান। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে তারা মারামারিতে লিপ্ত হয়। এতে ভারতের কর্নেল পদমর্যাদার অফিসার সহ ২০ জন সৈন্য নিহত এবং ৭৬ জন সৈন্য আহত হয় এবং ১০ জন অপহৃত হয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই সংঘর্ষে ্একটি গুলি ও ব্যবহার করা হয়নি। ভারতের দাবী চীনারা পেরেক যুক্ত লোহার রড ব্যবহার করে। চীনের অভিযোগ ভারতীয় বাহিনী চুক্তি লংঘন করে সহিংস ভাবে চীনা সেনাদের উপর আক্রমন করে। ২২ জুন এক সমঝোতা বৈঠকের পর উভয় বাহিনী পিছু হটতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত লংঘনের পরস্পর বিরোধী অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে।
চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাত বাংলাদেশের জন্য এক উভয় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে শুল্ক মুক্ত বাণিজ্য সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু ভারতের দিক থেকে অশুল্ক জনিত বাঁধার কারণে বাংলাদেশ এ থেকে কোন উপকৃত হতে পারেনি। অপর দিকে চীন ৮২৫৬ টি পণ্যের উপর শুল্ক ও কোটা মুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছে। যা আগামী ১ জুলাই কার্যকর হবে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে গেলে প্রয়োজন- উৎপাদন দক্ষতা ও সক্ষমতা ।
চীন কর্তৃক বাংলাদেশকে শুল্ক ও কোটা মুক্ত রপ্তানি সুবিধা প্রদান ভারতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘খয়রাতি’ বলে অভিহিত করেছে। যা এদেশের জন্য মর্যাদা হানিকর। তবে এর জন্য ভারতের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
এশিয়ার এই দুই ক্ষমতাধরের সাথে বাংলাদেশের বহুবিধ স্বার্থ জড়িত। ভারত আমাদের সন্নিহিত প্রতিবেশী। ভারতের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক ,রাজনেতিক ও কুটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমান সময়ে সর্বোচ্চ উচ্চতায় রয়েছে। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার প্রভাব পরিব্যাপ্ত। আবার চীন আমাদের অন্যতম বড় উন্নয়ন সহযোগী, বাণিজ্যিক অংশীদার ও সমরাস্ত্রের বৃহৎ সরবরাহকারী। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাত বৃদ্ধি পায় তবে আমাদের করণীয় কী হবে?
১৯৪৭ সালে বাংলাদেশের কোন সমুদ্র বন্দর ছিল না। সে সময়ের সরকার স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের কাছে কোলকাতা বন্দর ব্যবহারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর জন্য সাবমেরিন সংগ্রহ ভারত সরকার ও এর মিডিয়ার উষ্মার শিকার হয়েছিল।
অপর দিকে চীন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ পথ হিসেবে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর ব্যবহার করছে। এটা চীনের অর্থনেতিক ও কৌশলগত সামরিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ২০১৭ সালে মিয়ানমার রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়ন শুরু করলে চীন মিয়ানমারকে মদদ দিতে কার্পণ্য করেনি। অন্যদিকে রোহ্গিংা ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধের চাপ না দিয়ে ভারত নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থে মিয়ানমারকে খুবই দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ করে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা আগে ভাবতে হবে। কথায় বলে, উত্তমে উত্তমে ঝগড়া হয়, উত্তম অধমে দাসত্ব হয়, মধ্যম থাকে তফাতে তফাতে। আত্মমর্য়াদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে আমাদের সঠিক পদক্ষেপই কাম্য।

*প্রভাষক,সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ

Check Also

ভোমরা বন্দরে চার মাসে ৪০০ কোটি টাকা আয়

দক্ষিণবঙ্গ সাতক্ষীরার আধুনিক নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব বাণিজ্যিককেন্দ্র ভোমরা স্থল বন্দর। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।