ক্রাইমর্বাতা রিপোট: আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরার পশ্চিম সুন্দরবন অঞ্চল ঘুরে ফিরে: ওরা ভাল নেই। নেই ওদের স্বামী । পেটের দায়ে জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে লড়াকু সৈনিক। ওরা ‘বাঘ বিধবা’। দুর্বিসহ ওদের জীবন। স্বামীকে হারিয়ে শিশু সন্তানদের নিয়ে দুর্বিসহ জীবন কাটছে তাদের। ডিঙ্গি নৌকায় নদীতে মাছ শিকার বা ঘেরে দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে সংসার চলছে তাদের। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এভাবে কষ্টকর জীবন-জীবিকার মাধ্যমে নিজেদের শিশু-সন্তানদের বড় করছেন। কিন্তু তাদের কষ্টের জীবনে কোনও পরিবর্তন আসছে না। দেশ স্বাধীনের পর সুন্দরবন নির্ভর কয়েক হাজার পরিবার তাদের পুরুষ সদস্যদের বাঘের আক্রমণে খুইয়েছে। কেউ আবার বাঘের আক্রমণের সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু সাতক্ষীরা জেলায় এমন পরিবারের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।
সামনেই স্বামীকে টেনে নিয়ে গিয়েছে বাঘে। ভেসে গিয়েছে সংসার। অধিকাংশ পরিবারেই মহিলাদের জীবন যন্ত্রণা এবং দারিদ্রে ভরা। পুনরায় বিয়ে করাকে এখনও সমাজ সুনজরে দেখে না বলে এই বিধবাদের জন্য পুনর্বিবাহ করাটাও খুব কঠিন। পেটের দায়ে তাই তাঁরা সব জেনেও মৃত স্বামীদের মতোই ঝুঁকি নেন রোজ। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে ‘অপয়া’ অপবাদ, স্থানীয়ভাবে তাদের নতুন পরিচিতি হচ্ছে ‘বাঘ বিধবা’। স্বামীদের বাঘের পেটে যাওয়ার পেছনে যেনো তারাই দায়ী, এমন ধারণার কারণে গ্রামের অন্যরাও সেভাবে মেশেন না তাদের সঙ্গে। অভিযোগ, সরকারের থেকে ছিটেফোঁটা সাহায্য জোটেনি কারও। নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এখন সরকারের হস্তক্ষেপ চাইছেন তারা।
বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সুন্দরবনে আগের মতো বাঘের সেই ভয়াল নেই। বন উজাড়ে কমে গেছে সুন্দরবন সংলগ্ন জনবসতির আশেপাশে বাঘের আনাগোনা। হ্রাস পেয়েছে বাঘের সংখ্যাও। তবে বন বিভাগ বলছে তাদের তদারকি ও মানুষ সচেতন হওয়ার কারণে সুন্দরবনে বাঘের কবলে পড়তে হয়না তেমন কাউকে।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি এলাকার নীলডুমুর গ্রামে অর্ধশতাধীক পরিবারের সদস্যরা বাঘের পেটে। মোকসেদ সরদার। পেশায় বাউয়ালি। ১৯৮৮ সালে সুন্দর বনে মধূ সংগ্রহের সময় বাঘে ধরে নিয়ে যায়। একই বছরে বাঘে ধরে নিয়ে যায় একই এলাকার তেজরাত গাজী, মনুমোল্লা,মজিত সরদার,আরশাদ গাজী,মনিরুল,জিয়ারুলসহ অনেকে।
এমনই একজন ভুক্তভোগী নারী জোহরা। তিনি জানান, ২০০৯ সালে তার স্বামী তেজরাত গাজী সুন্দরবনে যান মাছ শিকারের জন্য। সেখানে গিয়ে পাটা জাল নিয়ে নৌকায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এসময় একটি বাঘ এসে তার ঘাড়ের ওপর হামলে পড়ে। এই অবস্থায় তার চিৎকারে অন্যান্য জেলেরা এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু ততক্ষণে বাঘ তার স্বামীর ঘাড়ের ওপর থেকে এক খাবলা মাংস তুলে নেয়। ফলে শেষ রক্ষা হয়নি। সেই থেকে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তার জীবনযুদ্ধ শুরু হয়। নদীতে মাছ ধরে, আর দিনমজুরি করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
শুধু জোহরা বেগমই নয়। সাতক্ষীরা,খুলনা,বাগেরহাট সহ সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন জেলার গ্রামগুলোতে রয়েছে এমন অনেক দুর্ভাগা নারী।
সোরা গ্রামের আর এক বাঘ বিধবা রুমিছা খাতুন। ৬/৭ মাসের সংসার জীবন তাঁর। স্বামী জঙ্গলে মাছ ধরতে যেয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হয়, তখন তিনি ৩ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেখান থেকে শুরু হয় জীবন সংগ্রামের চুড়ান্ত অধ্যায়। ২৮ বছর ধরে সন্তানকে বুকে আগলে কাটাচ্ছে দিন। সন্তান এখন জঙ্গলে যায়, উপার্জন করে। দুই বছর হলো বিয়ে দিয়েছেন। সরকারি খাস জমিতে একটা ঘর। এখনো বেড়া দিতে পারেনি। জায়গা খুব কম। তবু তিনি ভালো আছে।
৪০ বছর আগে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান তার স্বামী কৈখালী ইউনিয়নের মুন্ডাপাড়ার রূপামণি মুন্ডা। স্বামী ছিলেন বনজীবী; সংসার চলতো মাছ ধরে, কাঠ কেটে, মধু সংগ্রহ করে। রূপামণির কোলে যখন পাঁচ-পাঁচটি নাবালক শিশু, তখন মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে স্বামী লক্ষ্মণ মুন্ডা আর ফিরে আসেনি। পিতার চিতাভষ্মটুকুতে শেষ প্রণাম জানাতে পারেনি সন্তানেরা; একই খেদ তাঁর মনেও। এরপর নেমে আসে রূপামণির জীবন সংগ্রামের কঠিন অধ্যায়। ধনীদের বাড়িতে ধান ভেনে (ঢেঁকিতে), ক্ষুদ সংগ্রহ করে, পান্তার (রাতের ভিজানো ভাত) পানি চেয়ে উদরপূর্তি করেছে দিনের পর দিন। কোনোদিন তিনবার খাওয়া জোঠেনি তাঁদের সংসারে। এভাবে কালিন্দী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে অনেক জল। শুধু সময় ছুটেছে সময়ের তালে, ভাগ্য ফেরেনি রূপামণির জীবনের চাকার। এভাবে ছোট কাল থেকে ছেলে-মেয়েরা জন মজুরি দিয়ে বড় হয়েছে, সংসার করেছে। এখন আর খাওয়ার কষ্ট নেই তাঁদের। রূপামণি দ্বিতীয় শৈশবে জীর্ণ ঘরের বারান্দায়, শীর্ণ দেহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন পরপারের।
সুন্দরবন নিয়ে কাজ করেন সাংবাদিক পীযূষ বাউলিয়া পিন্টু। তিনি জানান সরকারী ভাবে বাঘ বিধবাদের তেমন কোন সহযোগীতা করা হয় না। চলতি সপ্তাহে তারা বাঘ বিধাব ট্রাজেডি ৮৬টি পরিবারের কাছে যান এবং সাহায্য সহযোগীতা করেন। বিগত ৩ দিনে ৮৬টি পরিবারের মাঝে তারা নগদ টাকা,শাড়ী, স্যালাইন ও পানিবাহিত রোগের ঔষধ বিতরণ করেন।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয়বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. বশির আল মামুন বলেন, ‘বর্তমানে সুন্দরবনে বনজীবী প্রবেশে অনেক বিধি নিষেধ রয়েছে। ফলে বনজীবীরা চাইলেই জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারছেন না। এর ফলে বনে এখন বাঘের আক্রমণের শিকার হওয়ার তেমন তথ্যও পাওয়া যায় না। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি ও বাঘের অবাধ বিচরণ নিশ্চিতকরণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশেও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।’
বাঘে খাওয়া পরিবারের দাবী সরকারি বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করা হলেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। বাঘ বিধবাদের জন্য সরকারের আলাদাভাবে ভাবা প্রয়োজন।’ স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।