আম্ফানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরার কাঁকড়া শিল্প ॥ চলতি মাসে রপ্তানি হবে কোটি টাকার কাঁকড়া

আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরার কাঁকড়া শিল্প
চলতি মাসে রপ্তানি হবে কোটি টাকার কাঁকড়া: বাজার সৃষ্টি হলে ছাড়িয়ে যাবে হাজার কোটি টাকরা বৈদেশি মুদ্রা

আবু সাইদ বিশ্বাস: সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ফিরে: ঘুণিঝড় আম্পানের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরার কাঁকড়া শিল্প। দিন রাত শ্রমিকের কর্মব্যস্ততায় মুখর হয়ে উঠেছে কাঁকড়া খামার গুলো। হাজার হাজার শ্রমিকের নিরলশ প্রচেষ্টায় চলতি মাসে বিদেশে রপ্তানি হবে এখানকার কাঁকড়া। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সাতক্ষীরায় কাঁকড়া চাষ কৃষকের মাঝে নব জাগরণ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও থ্যাইল্রান্ডে এসব কাঁকড়া রপ্তানি হবে। চলতি বছরে জেলা কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রায় একশ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আশা করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চিংড়ি ও জাতীয় মাছ ইলিশের পরই এখন কাঁকড়ার অবস্থান। ভাইরাসমুক্ত ও উৎপাদন খরচ কম থাকায় জেলায় দিন দিন কাঁকড়ার চাষ ও খামার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে চিংড়িতে ভাইরাস, রপ্তানি হ্রাস এবং দাম কমে যাওয়ায় চিংড়ি চাষিরা কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। ইত্যোমধ্যে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১০ ভাগ সবসিডিয়ারি দেয়ায় কাঁকড়া শিল্প ব্যবসায়ীদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ বাড়িয়েছে।

জেলা মৎস্য অদিপ্তর সূত্রের মতে জেলাতে ১০ হাজার ৮শ কাঁকড়া আহরণকারী রয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৫ জন,তালায় ৫শ জন,আশাশুনিতে ১২শ জন,কালিগঞ্জে এক হাজার জন, দেবহাটায় ৬শ জন এবং শ্যামনগরে ৭ হাজার কাঁকড়া আহরণকারী রয়েছে। তবে প্রকৃত পক্ষে এর সংখ্যা আরো বেশি।

কাঁকড়া শিল্পকে ঘিরে জেলাতে গড়ে উঠেছে এক বিশাল কর্মযোগ্য। ৮৩টি কাঁকড়া ডিপো গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে সাতক্ষীরা সদরে ৫ টি,তালায় ৮ টি,আশাশুনিতে ৫১৫ টি,কালিগঞ্জে ১০ টি, দেবহাটায় ১৫ টি এবং শ্যামনগরে ৩০ টি ।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ৩৫৪ হেক্টর জমিতে কাঁকড়ার চাষ হয়। এর গড় উৎপাদন প্রতি বছর ৩ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর ২২৫২ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ৫৩০ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়। প্রকার ভেদে প্রতি কেজি কাঁকড়া ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। জেলায় মোট ২৩৫৩টি কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। আর ছোট-বড় মিলে প্রায় ২ হাজার সরকারি-বেসরকারি মোটাতাজাকরণ কাঁকড়ার খামার গড়ে উঠেছে। সপ্ট সেল খামার রয়েছে ৮০টি, যেখানে ৮০ লাখ প্লাস্টিকের খাঁচায় কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ ও চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় রপ্তানি আয়ে উপাদানগুলোর মধ্যে কাঁকড়ার অবদান এখন গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে সাতক্ষীরায় চাষ হওয়া এসব কাঁকড়া আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে কাঁকড়া রপ্তানি করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হচ্ছে।

বিশালাকৃতি বেশ কয়েকটি পুকুর রয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দাতিনাখালী গ্রামের ইটের সলিং রাস্তার দুই পাশে। সেগুলোতে ভাসছে প্লাস্টিকের ছোট ছোট অসংখ্য খাঁচা (বক্স)। পুকুরের মধ্যে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত আছে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে বানানো টিনের ছাউনি দেওয়া টংঘর। যে দিকে চোখ যায় শুধু ভাসছে প্লাস্টিকের ছোট ছোট অসংখ্য খাঁচা। প্রতিটা খাচা যেন চাষীর স্বপ্ন। প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর এসব খাঁচা চেক(খুলে দেখা) দিতে হয়।

শুধু ফরিদ নাইন স্টার অ্যাগ্রো বিডি লিমিটেডের ১০টি পুকুরে ৬লক্ষ বক্স ফেলা হয়েছে। শুধু শ্যামনগর অঞ্চলে ৩শ খামারে ৩০ লক্ষ বক্স রয়েছে। এসব বক্স থেকে প্রতি মাসে একশ টন রপ্তানি যোগ্য কাঁকড়া উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য ১০ কোটি টাকা। সেই হিসেবে বছরে ৮ মাসে ৮০ কোটি টাকর কাঁকড়া শ্যামনগর থেকে উৎপাদন হয়। ফরিদ নাইন স্টার অ্যাগ্রো বিডি লিমিটেডের ম্যানেজার আমির হোসেন এমন তথ্য দেন। তিনি জানান, চলতি বছরে তাদের খামার থেকে ৩টি চালান রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে ১৩ মে:টন, বেলজিয়ামে সাড়ে ৬ মে:টন এবং আস্ট্রেলিয়ায় ১.১০ মে,টন রপ্তানি করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। যা বিগত বছর গুলোর তুলনায় অনেক কম।

এই চিত্র ‘ফরিদ নাইন স্টারস অ্যাগ্রো বিডি লিমিটেড’ নামের কাঁকড়ার খামারের ৮৯ বিঘা জমির ১০টি পুকুরে প্লাাস্টিকের খাঁচায় চাষ হয় ছয় লাখ কাঁকড়া। বছরে উৎপাদন প্রায় দেড়শ’ টন কাঁকড়া। যার সবই রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা, কর্মসংস্থান হয়েছে ৪০০ নারী-পুরুষের। তাদের দেখা দেখিতে কাঁকড়া চাষে আগ্রহী হয়েছেন আরও কয়েকশজন।
এ্যানেজার আরো জানান, প্রকল্পের মালিক মো. বেলাল হোসেন মাঝে মাঝে দেশের বাইরে বেড়াতে যেতেন। একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে কাঁকড়া চাষের খামার দেখে তার খুবই পছন্দ হয়। পরিকল্পনা করেন ওই পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষের। এরপর ২০১৪ সালে ৯ বিঘা জমিতে একটি পুকুর কেটে সেখানে পরীক্ষামূলকভাবে কাঁকড়া চাষ শুরু করেন। তখন প্লাস্টিকের বক্সে কাঁকড়া ছিল মাত্র ১০ হাজার। এই পদ্ধতির চাষে সফল হওয়ায় তিনি পরে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন শুরু করেন। চিংড়ি থেকে কাঁকড়া চাষে লাভ বেশি। তাই পেশা পরিবর্তন করে কাঁকড়া চাষে এসেছেন একই এলাকার ছাত্তার। তিনি জানান,প্লাস্টিকের খাঁচায় একটি করে কাঁকড়া রেখে দুই-তিন সপ্তাহ পরিচর্যার পর কাঁকড়ার খোলস পরিবর্তন করা হয়। এতে কাঁকড়ার ৮০ ভাগ ওজন বৃদ্ধি পায়। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর কাঁকড়া প্যাকেটজাতকরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে কাঁকড়ার খোলস নরম থাকে। এর চাহিদাও বেড়েছে। দামও ভালো। ৩শ টাকা কেজি কিনে চাষ করে প্রকার ভেদে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। এতে লাভ বেশি ও রোগবালাই কম হওয়ায় সাতক্ষীরায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে খাঁচায় কাঁকড়া চাষ পদ্ধতি।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, প্রতি বছর কাঁকড়া রপ্তানি করে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সারা দেশে যে পরিমাণ কাঁকড়া বিদেশে রপ্তানি করা হয় উল্লেখ যোগ্য অংশ উৎপাদিত হয় সাতক্ষীরা জেলায়। সরকার কাঁকড়া চাষের ওপর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ফলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে।
বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এখ্যাত থেকে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

ছবির ক্যাপশান:১. সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি এলাকার দাতিনাখালি গ্রামে ‘ফরিদ নাইন স্টারস অ্যাগ্রো বিডি লিমিটেড’ খামারে কর্মরত কাঁকড়া চাষী।
২. সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি এলাকার দাতিনাখালি গ্রামে কাঁকড়া চাষি ছাত্তারের কাঁকড়া ঘের।

আবু সাইদ বিশ্বাস:সাতক্ষীরা:

Check Also

আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের খালিয়া রাস্তার বেহাল দশা।। বিপত্তিতে শতাধিক পরিবার।।দ্রুত সংস্কার দাবি 

এস,এম মোস্তাফিজুর রহমান,আশাশুনি।।আশাশুনি উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড খালিয়া গ্রামের সানাপাড়ার প্রায় শতাধিক পরিবার একটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

***২০১৩-২০২৩*** © ক্রাইমবার্তা ডট কম সকল অধিকার সংরক্ষিত।