মুহাম্মাদ ওবায়দুল্লাহ*
লিবিয়া প্রাচীন ইতিহাস বিশিষ্ট, উত্তর আফ্রিকার তেল সমৃদ্ধ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে এদেশে ইসলামের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত রোমানরা দেশটি শাসন করে। ১৯১১ সাল পর্যন্ত এদেশটি তুর্কী ওসমানিয়া খেলাফতের অধীন পরিচালিত হয়। ১৯১২ সাল হতে ইটালি শাসন থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য ওমর মুখতার নেতৃত্বে লিবিয়ানরা গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৩১ সালে ওমর মুখতার ইটালিয়ানদের হাতে গ্রেফতার ও ফাঁসী প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত ২০ বছর ব্যাপী এ যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। ১৯৫১ সালে লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করলে বাদশাহ ইদ্রিস এদেশের শাসক হন।
স্বাধীনতা লাভের পর লিবিয়ায় একের পর এক তেল ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় । তখন এ দেশটি একটি সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালে ২৭ বছর বয়সী সামরিক অফিসার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির নেতৃত্বে এক রক্তপাতহীন অভ্যূত্থানে বাদশাহ ইদ্রিস ক্ষমতাচ্যূত হন। তার ৪২ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনকালে লিবিয়ানদের মাথাপিছু আয় ছিল ১২ হাজার ডলার। ২০১১ সালে পশ্চিমাদের সমর্থনে এক সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি শাসনের অবসান ঘটে এবং তিনি নিহত হন।
গাদ্দাফি যুগের অবসান হলে ও দেশটিতে শান্তি ফেরেনি। দেশটির অস্থিরতা, শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে ২০১৪ সালে দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একেদিকে রয়েছে জাতিসংঘ সমর্থিত আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ফাইয়াজ আল সাররাজ এর নেতৃত্বে ত্রিপোলি ভিত্তিক ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল এ্যাকর্ড’ (জিএনএ) সরকার অপর দিকে আছে জেনারেল হাফতারের নেতৃত্বাধীন তার ভাষায় লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) ও পূর্বাঞ্চলীয় তোবরুক ভিত্তিক সরকার ।জানা যায়, জে. হাফতার এক সময়ে গাদ্দাফির সহযোগী থাকলেও ১৯৮০ সালের পর পক্ষ ত্যাগ করেন এবং ২০১১ সালে দেশে ফেরার পূর্ব পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় (সিআইএর সদর দপ্তরের কাছে) নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। গত ছয় বছরে পূর্বাঞ্চলীয় বেনগাজি শহর হাফতারের মূল ঘাঁটি হলেও তিনি রাশিয়া, মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃক সরবরাহকৃত যুদ্ধ বিমান, প্রযুক্তি সহায়তা ও বিদেশি মিলিশিয়া সমর্থনে দেশটির দুই তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তিনি ত্রিপোলি দখলের অভিযান শুরু করেন।
মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, রাশিয়া হাফতারের সহায়তার জন্য সুখোই-২২, মিগ-২৯ ফাইটার জেট ও উন্নত রাডার সিস্টেম পাঠিয়েছে। লিবিয়া ও ইউরোপীয় সূত্রে প্রকাশ,রাশিয়ার সামরিক ঠিকাদার ওয়াগনার গ্রূপ (যার মালিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি) লিবিয়ায় প্রায় ২০০০ বিদেশি ভাড়াটে সৈন্য মোতায়েন করেছে। মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশটির গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত ২ (দুই) লক্ষ লোককে ঘর-বাড়ি হারা হতে হয়েছে। পশ্চিম লিবিয়ায় এমন কিছু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ও গণ কবর আবিষ্কৃত হয়েছে যা হাফতার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
গত জানুয়ারি মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগান ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মস্কোয় এক শীর্ষ সম্মেলনে লিবিয়ার বিবাদমান দল গুলোকে নিয়ে এক যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে পৌছান। হাফতার সহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ এ চুক্তির শর্তগুলো মেনে নিলেও অজ্ঞাত কারণে জেনারেল হাফতার রাশিয়া ও তুরস্কের প্রস্তাবিত নথিতে স্বাক্ষর না করে মস্কো ত্যাগ করেন।
এর মধ্যে গত ২৭ নভেম্বর ২০১৯ আঙ্কারা ও ত্রিপোলি দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে । এক: সামরিক সহযোগিতা , দুই : পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সমুদ্র সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত।এই চুক্তির আওতায় জাতিসংঘ সমর্থিত আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল এ্যাকর্ড (জিএনএ) সরকারের সমর্থনে ত্রিপোলিতে সেনা মোতায়েন করেছে। তুর্কিদের সহায়তায় সরকারি বাহিনী গত ১৪ মাস ধরে ত্রিপোলি দখলের জন্য অভিযানরত হাফতার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক বিজয় লাভ করেছে। সরকারি বাহিনী কৌশলগত বানি ওয়ালিদ এয়ারপোর্ট ও তারহুনা শহরের দখল নিতে সক্ষম হয়েছে। জিএনএ বর্তমানে ত্রিপোলি থেকে ৪৫০ কিমি পূর্বে লিবিয়ার অন্যতম তেল রফতানি বন্দর সির্তেকে টার্গেট করেছে। যেটি সাবেক শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির জন্মস্থানও বটে।
ইন্টারফ্যাক্স বার্তা সংস্থার খবর অনুযায়ী রাশিয়া পূর্বাঞ্চলীয় তোবরুক এ দুতাবাস চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফ্রান্স ত্রিপোলি ভিত্তিক সরকারের অব্যাহত অগ্রযাত্রায় তুরস্কের কঠোর সমালোচনা করেছে। হাফতার মিলিশিয়াদের ফেলে যাওয়া এলাকায় গণ কবর আবিষ্কারের পর জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক বিচারকরা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টির মুখপাত্র বলেছেন, (ফ্র্রান্স) তুরস্ক বা আমাদের প্রেসিডেন্টের উপর অতিরিক্ত হামলার মাধ্যমে গণকবর গুলো ঢেকে রাখতে পারে না।’ জিএনএ সরকার কর্তৃক প্রধান তেল সুবিধার প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত গুরুত্বপূর্ণ সির্তে অভিযানের মুখে মিশর লিবিয়ায় সেনা মোতয়েনের হুমকি দিয়েছে। ইসরাইলি থিংক ট্যাংক জিএনএ সরকারের অগ্রগতিকে তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এতদিন নিরবতা পালন করলেও আমেরিকা এখন দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে,যে সমস্ত সশস্ত্র দলগুলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নষ্ট করার চেষ্টা করছে অথবা অস্থিতিশীল কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের বরদাস্ত করা হবে না- এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নিতে হবে।’ রাশিয়ান ওয়াগনার গ্রূপের সাথে এলএনএ র সম্পৃক্ততা লিবিয়া ও আমেরিকার স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তারা মনে করে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আরো বলছে যে, যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়া সংঘাতের একটি কুটনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছে যখন আঞ্চলিক শক্তিগুলো প্রক্সি যুদ্ধে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন লিবিয়া সংঘাতে জড়িত সকল পক্ষকে সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ এবং রাজনৈতিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার আহবান জানিয়ে বলেছে , লিবিয়া সংকটের কোন সামরিক সমাধান নেই। এটি নিষ্পত্তি করার একমাত্র উপায় অবশ্যই রাজনৈতিক যা সম্প্রতি জাতিসংঘ প্রস্তাবে পেশ করা হয়েছে।’
জাতিসংঘের লিবিয়া সংক্রান্ত সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি ঘাসান সালামে (যিনি ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন) বলেন, লিবিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করা Ñ একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং নিরাপদ লিবিয়া পুনর্নির্মানের একমাত্র উপায়।
গত এপ্রিল-২০ পর্ন্ত রাজধানী ত্রিপোলিতে বিদ্রোহী হাফতার বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে এটা প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, তাকে সমর্থন কারীরা ( আমিরাত, মিশর ও রাশিয়া ) হাফতারের উপর ভর করে লিবিয়ায় একটি সামরিক সমাধানের চেষ্টা করছে। যেটা সমগ্র লিবিয়ার জনগণের জন্য মারাত্মক ব্যাপার । কারণ হাফতার বাহিনী দেশের দুই তৃতীয়াংশ দখল করলেও তিনি সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন না। কিন্তু কোনঠাসা হওয়া ত্রিপোলি সরকার তুর্কী সহায়তায় ইতোমধ্যে রাজধানীর নিকটতম অঞ্চল থেকে হাফতার বাহিনীকে পশ্চাদোপসারণ করতে বাধ্য করেছে- যার ফলে এটা স্পষ্ট যে, লিবিয়া সংকটের কোন সামরিক সমাধান নেই।
এই অর্থহীন যুদ্ধ শেষ করার একমাত্র সম্ভাব্য উপায় হচ্ছে,আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে সূচিত বার্লিন শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে হবে। জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে ও সামরিক শাসন যাতে না ফিরে আসে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। গণতন্ত্রের পথকে সমর্থন করতে হবেÑ সেজন্য তাদের নীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। একটি বেসামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের সিরিয়াস হতে হবে।
লেখক: সাতক্ষীরা পিএন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সাতক্ষীরা